statcounter

Tuesday, May 24, 2016

গরম ভাত আর মধুচন্দ্রিমার গল্প

ভোর হয়েছে। চারদিক শান্ত, শীতল বাতাস বইছে। একটা পাখি ডাকছে মিষ্টি সুরে। চারপাশে একটা হাল্কা আলো, স্বপ্নিল হয়ে আছে যেন। জানলার পরদা উড়ল, আর প্রথম রবিকিরণ এসে পড়ল বেহুলার চোখে। লক্ষীন্দরের নজর এড়ায়নি দৃশ্যটা। ভোরবেলাগুলো ভারি সুন্দর। প্রথম সূর্যের ছটায় যখন বেহুলার ঘুমন্ত চোখের পাতাটা একটু কুচঁকে ওঠে, নরম আলোতে ওকে আর মোহময় দেখায়।
সাতদিন ধরে  দেখছে এটা, সাতদিন আগেই তাদের বিয়ে হল কিনা।

কিন্ত ু আজকের দিনটা সামান্য বিরক্ত হয়ে আছে  লক্ষীন্দর। আজকে তাদের মরিশাস বেড়াতে যাবার টিকেট এক্সপায়ার হয়ে যাবে। অনেক খুঁজে খুঁজে ভাল ডীল জোগাড় হয়েছিল, ডেট রিল্যাক্সেশন ও ছিল, কিন্ত ু আজকে পর্যন্ত। বাট মনে হয় যাওয়া ক্যানসেল করতে হবে। যত নষ্টের গোড়া হচ্ছে ঐ মনসা বুড়ী।

সাত দিন হয়ে গেছে বিয়ের। মনসা বুড়ী এখন রিচুয়ালিস্টিক স্নেক বাইট দিতে আসেনি। তাই রাতে বাড়ি ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকা যাচ্ছে না। বুড়ী খবর পাঠিয়েছে  পেট খারাপ হয়ে নাকি হসপিটাল এ ভরতি হতে হয়েছিল, এখন একটু সুস্থ না হয়ে অফিস এ আসতে পারছে না। পেট খারাপ তো হবারই কথা। বেহুলা-লক্ষীন্দরের রিসেপশন পার্টি তে এসে অতো চীজ আর চিকেন খেলে পেট খারাপ না হয়ে যাবে কোথায়। আর ড্রিংকস্ এর কথা নাই বললাম। বয়স তো কম নয় বুড়ীর--- নয় নয় করে হাজার দেড়েক। এসব ভেবে গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল লক্ষীন্দরের।

বাবার উপরে ও রাগ হচ্ছিল। এতদিন হয়ে গেছে, এখন ও প্রত্যেক জন্মে সেম রিচুয়াল পালন করার কি দরকার। আগে হলে হয়ত বাবা রাজি হয়ে যেত কিন্ত ু যবে থেকে মনসার সঙ্গে স্নেক অ্যান্টিভেনম এর নতুন ব্যবসা শুরু করেছে তবে থেকে দুজনের গলায় গলায় ভাব। আর মনসাকে চটাতে চায় না চাঁদ বণিক, প্রথম জন্মের শিক্ষা এখনো মনে আছে তাঁর। 

ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে লক্ষীন্দর চাঁদকে জিজ্ঞেস করল মনসার খবর। চাঁদ বণিক বুঝতে পারছে ছেলের রাগটা। কিন্ত ু তাঁর নিজের হাত পা বাধা। লাস্ট ইয়ার ১০৯ নং ব্রেকআপটার পর মনের সঙ্গে শরীরটাও ভেঙ্গে গেছে মনসার। চাঁদের কাছে এসে রীতিমত কান্নাকাটি করত তখন। বুড়ো বয়সে মনের উপরে ধাক্কাটা বেশি লাগে কিনা, চাঁদের নিজের এক্সপিরিএন্স তাই বলে। এর পর থেকেই তো 
ড্রিংকিং প্রব্লেমটা বেড়ে গেছে মনসার। এই অল্প বয়সি ছেলেরা কি বুঝবে, এদের প্রেমের কোন গভীরতা আছে নাকি। আর মনসার বয়সের সঙ্গে রাগ কমেনি একদমই, বরং বেশী সেনসিটিভ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন, বার বার তাড়া দিলে চটে গিয়ে আবার কি শাপ দেবে অথবা বিজনেস এ কোন শত্রতা করে দেবে। এই ভেবে আর লাস্ট তিন দিন মনসাকে আসার জন্য তাগাদা দেয়নি চাঁদ। শুধু শরীরের খোঁজ নিয়েছে।

তবে আজকে একবার চেষ্টা করা যেতে পারে। এই ভেবে মনসাকে " কেমন আছ!" বলে একটা WhatsApp মেসেজ পাঠাল  চাঁদ বণিক। আধ ঘন্টা পরে মনসার ফোন।
"হ্যালো চাঁদ। আজকে ভাল আছি, আজকে রাতে তোমার বাড়ি যাবো। বেহুলা-লক্ষীন্দর কে বলে রেখো।"
" ঠিক আছে। ৭ টায় দিকে এস। এখানে ডিনার কোরো বরং। ভাল মাটন এনেছি আজকে।"
" খুব ভাল। সি ইয়উ অ্যাট সেভেন দেন।"

খুশী হয়ে চাঁদ বণিক লক্ষীন্দরকে খবরটা পাঠালেন।
বেহুলা তাড়াতাড়ি সুটকেস গোছাতে বসল। রাতে ফ্লাইটে আজকে তাহলে মরিশাস। তার আগে একটু পার্লার ও যেতে হবে।

সন্ধ্যে সাতটা। মনসা এলেন। সামান্য খাওয়া দাওয়া হল। তারপর মনসা ব্যাগ থেকে একটা স্নেক টীথ বের করে তাতে সামান্য বিষ ঢেলে নিয়ে লক্ষীন্দরের পায়ে একটু ফুটিয়ে দিলেন। বেহুলা কে সামান্য চোখের জল ফেলতে হল। বেহুলা ভেবেছিল একটু নাক টেনে কাজ চালিয়ে নেবে কিন্ত শাশুড়ি দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে চোখ থেকে দু ফোঁটা বের করতে হল। চাঁদ ও তৈরী ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে একটা অ্যান্টিভেনম ইঞ্জেকশন  দিলেন ছেলেকে, ১ ঘন্টা ঘুমিয়ে  নিয়ে লক্ষীন্দর ডিনার খেতে এল।

এর পর ওদের ফ্লাইট ধরতে ছুটতে হবে।

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

নৌকোটা নোঙ্গর করে সুজন মাঝি বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। ৩০ বছরে সা জোয়ান, বাড়িতে বাবা মা ছোট দুটো ভাই- বোন আর ফুলেশ্বরী, সুজনের চারমাস আগে বিয়ে করা বৌ। রাস্তা বলে কিছু নেই, মাটির পথ, পাশে ঝোপঝাড়। টর্চের ব্যাটারীটা গেছে। অন্ধকারে সাবধানে পা ফেলছিল সুজন মাঝি। খুব ক্লান্ত লাগছে, খিদে ও পেয়েছে ভীষণ। আজকে ভাল মাছ পাওয়া গেছে, ভাই- বোন দুটো মাছ খেতে খুব ভালবাসে, মাসের মধ্যে দু-এক দিনই খেতে পায় কিনা। ফুলেশ্বরীর রান্নার হাতটা ভাল, আজকে রাতের খাওয়াটা ভাল হবে, ভেবে খুশি হচ্ছিল সুজন, অন্যমনস্ক ও হয়ত। হঠাৎ পায়ের মধ্যে একটা তীব্র সূচঁ ফোটানোর মতন  জ্বালা হল, মাথাটা ঘুরে উঠল, পায়ের পেশীতে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হল।
অন্ধকারে মা মনসার চেলার উপরে পা পড়েছে, বুঝতে পারছিল সুজন। আবার কিছু বুঝতে পারছিল ও না। হাতের ঝুড়িটা পরে গেল, টর্চটাও, ব্যথায় নীল হয়ে যাওয়া সুজনও পড়ে ছিল রাস্তায়। দূরে গ্রামের মধ্যে কেরোসিনের আলো --- বাবা- মা- ফুলেশ্বরীর মুখ---- সুজন চেঁচাতে চাইছিল --- যদি কেউ শুনতে পায়, হাসপাতালে নিয়ে গেলে বেঁচে যাবে, যদি ১০ কিমি পথ যেতে যেতে প্রাণটা আটকে রাখতে পারে।


সুজনকে নিয়ে হাসপাতাল যাওয়া হচ্ছিল। পায়ে শক্ত করে কাপড় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, নৌকোর মধ্যে শুয়ে আছে সুজন, পাশে ফুলেশ্বরীর উৎকন্ঠ মুখ। ১০ কিমি রাস্তা।নৌকো থেকে নেমে ভ্যানে করে হাসপাতাল। সুজন স্বপ্ন দেখছিল--- হাঁড়িতে ভাত ফুটছে টগবগ করে, মাছ রান্নার গন্ধ আসছে।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

ফ্লাইট উড়ছিল। লেট নাইট ফ্লাইট। বেহুলা লক্ষীন্দর অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কাল থেকে সমুদ্র সৈকতে ওদের মধুচন্দ্রিমা।














4 comments:

  1. Re-imagining an old tale , a legend, a myth, a folklore is not an easy task .. but here you are ! I wouldn't say this is the best, because your posts are becoming better with each turn.

    Darun laglo ...

    ReplyDelete