statcounter

Monday, November 27, 2017

শীতকাল


কলকাতায় নাকি কালকে ১৫ ডিগ্রি ছিল ; শীতকাল এসে গেল।

শীতকাল মানে আলমারি থেকে বের হওয়া উলের সোয়েটার আর গরম মোজা; বাবার মাফলার আর মায়ের শাল। ট্রাঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসা রোদে দেওয়া লাল মলাটের লেপ; কমলালেবু আর নতুন গুড়ের পিঠে; বড়দিনের কেক। শীতকাল মানে দুপুর বেলা খাবার পর ছাদে বসে রোদ পোহানো; পর পর মেলার  কাউন্ট ডাউন; পিকনিকের প্রস্তুতি। সকালবেলা কাঁপতে কাঁপতে লেপ ছেড়ে ওঠা; আবছা কুয়াশার মধ্যে চায়ের দোকানের ধোঁয়া মিলিয়ে যেতে দেখা। সন্ধ্যেবেলা হুডির ওপরে চাদর জড়িয়ে ল্যাব থেকে বেরনো; খালের ধারে দাঁড়িয়ে চা খাওয়া; খবরে দমদমে আজকে ১০ ডিগ্রি শুনে "ওরে বাবা তাহলে এখানে ত ৭" বলে একটা এক্সট্রা চাদর জড়িয়ে নেওয়া।

এটাই আমাদের শীতকাল; দিল্লীর স্মগ বা নিউ ইয়ার্ক; সুইডেনের বরফে ঢাকা চারপাশ ; প্যাঁচ কেটে  যাওয়া কল থেকে টপটপ করে পড়া অবিশ্রাম জলের ফোঁটাতে গজানো স্যাঁতস্যাঁতে শ্যাওলার মত গায়ে লেপ্টে থাকা ঠান্ডা আমাদের নয়। আমাদের আসল শীতকাল আসে এখানে; ময়দানের মাঠে রঙীন বেলুনের উড়ানে; পার্ক স্ট্রীটের রাস্তায়; চিড়িয়াখানার ভীড়ে; শীতকাল আসে সকালের কুয়াশা কাটিয়ে ঝকমকে রোদের হাত ধরে; সন্ধ্যের হলুদ আলোর মায়াবী বিষণ্ণতায়; রাতের নিঝুমতায়;  ফোনে মায়ের কথায়। শীতকাল আসে কোলকাতায় আর আমরা যারা পড়ে আছি বেশ কিছুটা দূরে ; পঁচিশ-ত্রিশ বছরের মায়া কাটিয়ে উঠছি প্রতিনিয়ত; শুধু নতুন করে পুরোনো মায়াতে জড়াবো বলে; লেপের গরম ওমের  ভালবাসা নিয়ে শীতকাল আসে আমাদের বুকের মধ্যে।





  .



Saturday, August 19, 2017

মধুচন্দ্রিমা- পর্ব ২-কাইস মনাসট্রি-জনা ফলস- রোটাং পাস -নগর

সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম কাজ হল বারান্দাতে বেরিয়ে বাইরের পাহাড়গুলো দেখা। রোজ তাদের রূপ বদলায়; একই দৃশ্য তাও যেন নতুনের মতো লাগে। সারারাত বৃষ্টি হয়ে সকালে আকাশ পরিস্কার হয়েছে; সূর্যের আলো পড়েছে পাহাড়চূড়ায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তেজ পাল্টায় , আস্তে আস্তে মেঘ এসে জমা হয় পাহাড়ের মাথায়, নামতে থাকে নীচের দিকে। ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায় চারপাশ; তাতে খুব ভীড়ের মধ্যেও একা লাগে নিজেকে।

আজকে আমাদের যাবার কথা কাইস মনাসট্রি আর জনা ফলস দেখতে। নগর থেকে কুলুর দিকে ১২ কি মি দূরে ছোট্ট কাইস মনাসট্রি। সামনে সবুজে ঘেরা পাহাড়ের সারি দিগন্ত ছুয়ে আছে।লামা কোয়াটারসের পাশ দিয়ে; বাগান পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে উপাসনা গৃহ। বিশাল কাঠের দরজা আর লাল পরদা দেওয়া জানলাওলা ঘরে হাজার রকম তিব্বতী দেবতা আর বুদ্ধের অবতারের ছবি এবং মূর্তির সমারোহ। তার মাঝে স্মিত মুখে তথাগত বসে আছেন। সামনে দলাই লামার হাসি মুখ। আমরা এসেছি পুজোর সময় পেরিয়ে, তাই এখন ফাঁকা। বেরনোর সময় বোঝা গেল এটা আসলে লাঞ্চ টাইম-- কিচেনের সামনে সবাই ভীড় করে আছে; হাসি হাসি মুখে ম্যাগি ভরতি বাটি নিয়ে ফেরত যাচ্ছে বাচ্চা লামারা। দেখা হল নানা সাইজের পোষ্যদের সঙ্গে; তারা ল্যাজ নেড়ে নেড়ে চলেছে লামার পেছন পেছন; অথবা শুয়ে আরাম করছে।





এবার যাত্রা শুরু জনা ফলসের দিকে। কাইস থেকে নগর পার হয়ে আরো ওপরের দিকে জনা ফলস। লোকালয় পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ী চলল। জায়গায় জায়গায় রাস্তা ভাঙ্গা, ভিজে মাটি; গাছের পাতায় ঢাকা। গাছেরা একে অন্যের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঝুপ্সি হয়ে আছে মাথার ওপরে। বৃষ্টি পড়ছে ঝিমঝিমিয়ে; গাছের মাথার ওপরে জমে আছে তুলো তুলো মেঘ; নিজের ইচ্ছে মতো ভেসে যাচ্ছে এদিকে থেকে ওদিকে; এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে। এরকম ভাবে ১ ঘন্টা মতো চলার পর আমরা পৌছালাম জনা ফলসে। রাস্তার দুদিক দিয়ে ধাপে ধাপে নেমে গেছে সরু ঝর্ণা নেমেছে; স্রু কিন্তু বর্ষায় বেগবান। 




জনা ফলসের আকর্ষণ দুরকম ; অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়দের জন্য ভ্যালী ক্রসিং আর সবার জন্য হিমাচলী খাবার। চার পাঁচটা ছোট ছোট ঝুপড়ি; তাতে কাঠের জ্বালে রান্না হচ্ছে। আমরা দৌড়ে গিয়ে সব চেয়ে শেষের খাবারের দোকানেটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। রাস্তা থেকে কিছুটা উঠে গিয়ে একদম  ঝর্ণার সামনে একটা বড় পাথরের উপরে খেতে বসার জায়গা। এখানে না বসতে চাইলে একটু নীচে নেমে আরো একটা পাথরের চাতাল; তার মধ্যে দিয়ে জল যাচ্ছে--- সেখানেও চেয়ার-টেবিল পাতা। বৃষ্টি না থাকলে ওখানে বসে থাকা যায় জলে পা ডুবিয়ে। আমরা ওপরের বসলাম;  হিমাচলী থালিতে এল;   লাল চালের ভাত; মকাইএর রুটি, সিদ্ধু (এপ্রিকটের পুর দেওয়া ঝাল পিঠের মতো) ঘি, বেসনের কাঢ়ী, রাজমার ডাল,  লিংরি নামের ফিড্লহেড ফার্নের তরকারি;  ঝাল আচার আর গুড়। বৃষ্টিতে লোকের ভীড় নেই বললেই চলে; জল পড়ার  শব্দ আর পাখির ডাক ছাড়া আশেপাশে কোন শব্দ নেই ; সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল সময় যেন থেমে গেছে ।ওখানে ঘন্টা দুয়েক কাটিয়ে আমরা ফিরে আসলাম হোটেলে।




পরের দিন যাবার কথা 50 কি মি দূরে রোটাং পাস দেখতে (উচ্চতা  3978 মিটার; মানালীর প্রায় দ্বিগুণ)। মানালী থেকে সব্বাই যাচ্ছে রোটাং এ আর তাই নাকি সাঙ্ঘাতিক জ্যাম রাস্তাতে। জ্যামের ভয়ে আলো ফোটার আগেই বেরনো হল হোটেল থেকে। গাড়ী চলেছে ঘুমন্ত শহরের মধ্যে দিয়ে। আকাশের রং আস্তে গাঢ় নীল থেকে হাল্কা নীল হল; তাতে ফুটে উঠল লালের ছোঁয়া, ভোর হল। নেহেরু কুন্ড পেরিয়ে; সোলাং ভ্যালীকে বাঁ পাশে রেখে আমরা চললাম। মাঝে গুলাবাতে চেক পয়েন্টে দাঁড়াতে হল; লম্বা লাইনের পেছনে। রাস্তা দিয়ে নানা সাইজের গাড়ি ছাড়া চলছে হিমাচল ট্যুরিজমের বাস; বাইক যাচ্ছে রোটাং পেড়িয়ে কেলং বা লেহতে। গুলাবার পরে আর কোন স্টপেজ নেই--- হু হু করে পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে গাড়ি উঠছে, পাশে দৃশ্যের পর দৃশ্য পরিবর্তন হচ্ছে। শুরুতে বড় বড় গাছ, সবুজ পাহাড়; তার বুক চিরে তিরতির করে নেমেছে নাম না জানা ঝর্ণা, বয়ে চলেছে গিরিখাতের দিকে। যত ওপরের দিকে উঠছি গাছের সংখ্যা কমে আসছে, পাথরের গায়ে সবুজ কার্পেটের বিছানা; আরো ওপরে একদম ন্যাড়া পাহাড় । সকালে যখন বেড়িয়ে ছিলাম তখন বুঝিনি, গুলাবা পার হয়ে কিছুদুর পরে আমাদের সঙ্গ নিল মেঘ আর বৃষ্টি। চারপাশ ঢেকে গেছে ধোঁয়াধোঁয়া মেঘে; দৃশ্যমানতা একদম কম; তার মধ্যে হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ী চালাতে হচ্ছে;আমরা কাঠ হয়ে বসে আছি।  এরকম ভাবে মেঘ জমা আর মেঘ কাটার মধ্যে দিয়ে আমরা পৌছালাম জীরো পয়েন্টে । সেখানে তখন বৃষ্টি নেমেছে; পাঁচ লেয়ার গরম জামা ভেদ করে হিম করে দিচ্ছে হাওয়াতে।   সবাই এর মধ্যেই বরফের ওপরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে; অনেকে এতো ওপরের  দিকে উঠে গেছে যে রাস্তা থেকে দেখাই যাচ্ছে না। ঠান্ডাতে আর হাইট সিকনেসে আমার তখন ছেড়ে দে মা অবস্থা। তাই বিয়াস কুন্ড না দেখেই আমরা নেবে এলাম; রোটাং এ আমাদের কোন ছবি তোলা হল না। ফেরার সময় দেখা পেলাম রোটাং এর বিখ্যাত জ্যামের---পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে  কয়েক কি মি ধরে গাড়ীর লাইন; একচুল করে নড়ছে। আমরা হোটেলে ফিরলাম দুপুর দুটোতে।

                                      






                                   
জীরো পয়েন্ট


ফিরে এসে ট্রাউট ফিশ দিয়ে লাঞ্চ

নগর ক্যাসেলের পাশেই আছে রাগিণী ক্যাফে; তারই অংশ লাভাজা। রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা ওপেন ক্যাফে। হানি-জিঞ্জার-লেমন টী আর এপ্রিকট কেক দিয়ে বিকেলের খাবার হল। একগাদা আদা ভেজান গরম জলের মধ্যে লেমন টী এর ব্যাগ ডুবিয়ে চা তৈরী হয়ে গেলে মেশাতে হবে আপেলের ফুলের মধু। আমার সকাল  সন্ধে চা লাগে--- আমার কাছে তো এই বস্তু অমৃত সমান। আর আমার সঙ্গী যিনি মাসে দুবার চা খান কিনা সন্দেহ সেও খেল--দুবার অর্ডার দিয়ে।
হানি-জিঞ্জার-লেমন টী

রাতের খাবার

অন্যদিনের মতো আজও রাতে ক্যাসেল নিস্তব্ধ। সামনে পাহাড়ে জোনাকীর আলো; চারদিক ভরে আছে শব্দহীন নিশ্চিন্ততায়, দিন আসে--দিন যায়;   কিন্তু এই  দৃশ্য বদলায় না; বিয়াসের পাশে গড়ে ওঠে ঘরবাড়ি; আপেল বাগান কেটে হোটেল ওঠে--- তার মধ্যে সামনের পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকে---অনন্তকাল ধরে।
পরদিন যাবার কথা সোলাং ভ্যালীতে (চলবে)।









Sunday, July 23, 2017

মধুচন্দ্রিমা- পর্ব ১- দিল্লী- মানালী- নগর

মান্ডি হাউসের সামনে থেকে কাঁটায়- কাঁটায় সন্ধ্যে ৭.৩০ টায় হিমাচল ট্যুরিজমের বাস ছাড়ল।সামনে ১৪ ঘণ্টার জার্নি। বাস চলল উত্তরের দিকে, শহরের ভীড় কাটিয়ে হাইওয়ে ধরে। পাশে ধূ ধূ মাঠ--বা ক্ষেত আর মাঝে মাঝে বেমানান ভাবে একটা ধাবা কিংবা ম্যাকডোনাল্ডস, কে এফ সি; তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সারি-সারি দেশী-বিদেশী গাড়ি। মাঝখানে একটা ধাবাতে বাস দাঁড়াল, ডিনার এখানেই হবে। তারপর আর কোন বিরতি নেই, রাতের বাস চলল চন্ডীগড়ের মধ্যে দিয়ে হিমাচলের দিকে। আধো ঘুম, আধো জাগরণের মধ্যে পার হয়ে গেলাম বিলাসপুর আর সুন্দরনগর, পাশে চলতে শুরু করল বিয়াস নদী। সামনের ছয়দিনে এই নদী থাকবে আমাদের যাত্রাপথের সঙ্গী হয়ে, কখনো শান্ত, কখনো খরস্রোতা রূপে। ভোরের আলো ফুটতে দেখা গেল বিয়াসের পাশ দিয়ে ধাপে ধাপে উঠে গেছে  ঘন জঙ্গলে ভরা পাহাড়, তার মধ্যে দূরে একটা দুটো লাল টিনের চালওলা বাড়ি। বাস চলল বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের আঁকা বাঁকা রাস্তা ধরে; পার হয়ে গেলাম নাম না জানা ব্রীজ, ছোট ছোট লোকালয়। সকাল ৯ টায় বাস পৌছাল মানালীতে, সেখান থেকে আমরা যাব আরো ২০ কি মি দূরে; নগরে (নাগ্গর)।
মানালী থেকে নগর যাবার দুটো রাস্তা;  বিয়াসের দুদিক দিয়ে; একটা শহরের পাশ কাটিয়ে আর অন্যটা শহরের মধ্যে দিয়ে কুলুর দিকে। নগর হচ্ছে কুলুর রাজধানী; দিল্লী থেকে নগর যেতে হলে  মানালীতে না গিয়ে নামা উচিত পাতলিকুলে; সেখান থেকে নগর  ৫ কিমি  দূরে। রাস্তার পাশে আপেল বাগান; ভর্তি হয়ে আছে ছোট ছোট সবুজ আপেলে--পাকতে শুরু করবে আগস্টে। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে গাড়ী চলল আর মিনিট ৪৫ এ পৌছে গেলাম নগরে।
নগরে আমাদের থাকার কথা নগর ক্যাসেলে। ১৬০০ শতকে কুলুর রাজা বানিয়েছিলেন এই ক্যাসেলটি, যা এখন একটা হেরিটেজ সাইট এবং হিমাচল ট্যুরিজমের হোটেল। কাঠ আর পাথরের তৈরী বাড়িটা কুলু এবং ইউরোপীয়ান মিশ্র ধাঁচে গড়া। 
প্রথম দিন হোটেলে পৌছে ভীড় দেখে হকচকিয়ে গেছিলাম; হেরিটেজ সাইট টা ৩০ টাকা প্রবেশ মূল্য দিয়ে সর্বসাধারণের জন্য খোলা। গরমের ছুটি এখনো শেষ হয়নি; মানালীতে যেমন ভীড়; তেমনি ক্যাসেল দেখতে আসার লোকের বিরাম নেই।  যাত্রার ক্লান্তি, ঝিমঝিমে বৃষ্টি, ঘর তৈরী নয়; সব মিলিয়ে মেজাজটা আস্তে আস্তে খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। মেজাজ ঠিক হল ক্যাসেল রান্নাঘরে তৈরী অপূর্ব মাশরুম 'অন টোস্ট আর চীজ ওমলেট খেয়ে; তার সঙ্গে কফি। খিদে মিটতেই আমরা ফোটো সেশন শুরু করে দিলাম; নিজেদের আর সামনে পাহাড়ের।
বিকেলের দিকে বাইরের লোকের ভীড় কমে গেল; তখন একটা টুঁ শব্দ নেই চারপাশে। সামনের 
বারান্দার নিচে একটা পাথর বাঁধানো উঠোন; তার সামনে ধাপে ধাপে নেমে গেছে নগরের উপত্যকা; জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে বিয়াস নদী; আরো সামনে উঠে গেছে পাহাড়ের সারি- সবুজ থেকে নীলচে হয়ে গেছে মাথার দিকে, সকালে মেঘে ঢাকা ছিল, এখন পরিস্ফুট হয়েছে। নগর ক্যাসেলের চারদিকে সবুজে ঢাকা পাহাড়, তার মধ্যে লাল- সবুজ ছাদওলা বাড়ী, দূরে গাছের মাথায় আটকে
আছে ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ। সামনের পাঁচদিন আমরা থাকব এখানে--- মেঘ রোদ আর বৃষ্টি লুকোচুরির মধ্যে---- প্রায় স্বর্গের কাছাকাছি।
পাহাড়ে দেরীতে রাত হয়, যখন সন্ধ্যে হল তখন প্রায় আটটা বাজে। সামনে দূরে মিট মিট করে জ্বলছে শহরের আলো, ঠিক যেন জোনাকিরা জ্বালিয়েছে হাজার প্রদীপ।
পরদিন সকালে শুরু হল রোদ আর মেঘের খেলা। সামনের সব চেয়ে বড় পাহাড়ের মাথায় মেঘগুলো ভীড় করে আছে; আর তার ঠিক বা দিকে খাঁজ থেকে উঁকি মারছেন সূর্য। নীচে জমা হয়ে আছে সাদা সাদা মেঘ; বিয়াসের উপরে জমাট বাঁধছে। আরো দুরের পাহাড়ে তখনো নীলচে আভা; তার মাঝখান দিয়ে নেমেছে নাম না জানা নদী। কিছুক্ষ্ণ পরে আরো মেঘ এসে ঢেকে দিতে লাগল সব পাহাড়গুলো কে, ঠিক যেন নাটক শেষে মঞ্চে পরদা পড়ে গেল সামনে।








প্ল্যান ছিল যে কোনো প্ল্যান থাকবে না; ইচ্ছে হলে টুরিস্টের মত ঘুরব; ইচ্ছে না হলে নগরে বসে থাকব।প্রথম ইচ্ছেটার জয় হল; লাঞ্চের সময় গিয়ে পৌছালাম মানালীতে। মানালী শহরটা ছোট, সরু সরু রাস্তা এঁকে বেঁকে গেছে, তার মধ্যে হোটেল আর দোকানের ভীড়।ইন্টারনেটে আগে থেকে দেখে ঠিক করা ছিল কাসা-বেলা-ভিস্তা তে খাব। ওল্ড মানালীতে সুন্দর সাজানো গোছানো দোকান; পাশে আর ওপরে থাকার জায়গা। আমরা খেলাম চিজ কেক,  ব্র ুশেতা আর কাঠের উনুনে বানানো (মেনুতে তাই বলা ছিল) ফোর সিজন পিজ্জা। 



খাবার খেয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। ওল্ড মানালীতে ভীড় অপেক্ষাকৃত কম, বৃষ্টি ভেজা রাস্তা আর মাথার ওপরে পাইন আর ঝাউ গাছেরা মাথা গোঁজাগুঁজি করে দাঁড়িয়ে আছে; একটু দূরে পাহাড়ের গায়ে আরো সবুজ--আরো আরো বেশি ঘন। হেঁটে হেঁটে যখন গেলাম হাড়িম্বা মন্দিরে তখন অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। মন্দিরে চত্বরে লম্বা লাইন পড়েছে পুজো দেবার- সেই দলের আমরা অংশ নই। মন্দির থেকে একটু দূরে ছোট একটা মিউজিয়াম, সেখানে কিছুক্ষন থেকে ফিরে এলাম মল রোডে। মল রোডে যেন মেলা বসে গেছে; গিজগিজ করছে লোকের ভীড়ে। সেখান থেকে গাড়ি করে বিকেল বিকেল ফিরে এলাম  হোটেলে। 

রাত ১২ টায় বত্রিশে পা দিলাম আমি। ক্যাসেলের পাশে রাগিনী ক্যাফের একটা ছোট্ট দোকান--নাম লাভাজা; সেখান থেকে কিনে আনা হয়েছিল জার্মান বেকারীতে তৈরী অসামান্য স্বাদের ক্যারট কেক; একদম ফ্রেশ। সেটা খাওয়া হল রাতের বেলা। পরদিন যাবার কথা জানা ফলস দেখতে (চলবে)।

Friday, June 2, 2017

আ পার্ট অফ মি


সময় থেমে থাকে না। দেখতে দেখতে কেটে যায় ঘন্টা- দিন-সপ্তাহ-মাস-বছর। জমতে থাকে টুকরো টুকরো হাসি কান্না রাগ অভিমান সাফল্য ব্যর্থতার মুহূর্তগুলো। ফোর্থ ফেজ এর কমন ল্যাবে সারাদিনের হৈচৈ,টিস্যু কালচার- ডার্করুম -কনফোকালের বুকিং এর তাড়াহুড়ো; তার মধ্যে দিনে তিন বার ক্যান্টীনের চা আর খাবার; না আসা অথবা উল্টো আসা রেজাল্ট, ছাদের সিঁড়িতে আড্ডা; শনিবারের বিকেল মোমো খেতে যাওয়া আর মাঝে মাঝে মূর্তিমান ঝঞ্ঝাটের মত জার্নাল ক্লাব আর ডেটা প্রেসেন্টেশন। আর অনেকে মিলে হঠাৎ করে বেড়াতে চলে যাওয়া দার্জিলিং-কালিম্পং, গোপালপুর বা নেতারহাট কিংবা অল গার্লস' ট্যুরে মন্দারমণি বা তালসারি--- সব জমা হয় স্মৃতির খাতায়।
কাজের কথা আস্তে আস্তে শিফট হয়ে যায় মনের কথায় ; বিজ্ঞান থেকে সাহিত্য-সিনেমা ঘুরে ব্যাক্তিগত পরিসরে। তৈরী হয় একটা আনপ্যারালাল বন্ধুতের।  
সাত বছর থাকলে চেনা হয়ে যায় বারান্দার রেলিং, বুড়ো কুকুর আর তার ছেলেপিলের সঙ্গে।  জানা হয়ে যায় পলাশ- কৃ্ষ্ণচূড়ার ফুলের আনাগোনার সময়, শালের গাছের পাতা ঝরার পরে ন্তুন পাতা আসার দিনক্ষণ।

এসবের মধ্যে আস্তে আস্তে টপকে যায় একটা একটা মাইলস্টোন; পেপার- পাঁচ হাজার- থিসিস- ডিফেন্স। বদলে যায় ফোর্থ ফেজ এর মুখগুলো; আগে যারা পাশে বসতো তারা এখন হাজার মাইল দূরে--- স্কাইপ আর হোয়াটস্ -আপে।

সাত বছর--- সময়টা নেহাত কম নয়। যা কিছু নতুন শিখলাম- জানলাম--- সব কিছুর মধ্যে নিজেকে চিনতে শিখলাম; সাহা ইন্সটিট্যুট এ না এলে এগুলো এভাবে নিশ্চয় বুঝতাম না।
সব  বন্ধুরা চলে গেছে-- অন্য শহরে - অন্য অন্য দেশে; এবার আমার ও যাবার পালা--- নুতন করে শুরু করার সময়।

সাত বছর --সময়টা আসলে বেশ কম। চোখের পলকে কেটে যাওয়া----ভালো-মন্দ মেশানো সহজ- কঠিন মুহূর্তগুচ্ছ। 

ল্যাব থেকে যতই দূরে চলে যাই না কেন; মনের ভিতরে জ্ব্ল জ্ব্লে হয়ে থাকবে এই সময়টা আর স্মৃতিগুলো।
No matter how far I go, you will always be in my heart-----you will always be a part of me.

+









Sunday, February 26, 2017

শনিবার

লাল পাথর বিছানো রাস্তা, এবাড়ী থেকে ওবাড়ী যাবার। কয়েক বছর আগে রাস্তাটা সাদা ছিল।  রাস্তার পাশে সার সার গাছ। । ছড়িয়ে আছে ঝড়ে পড়ে যাওয়া শুকনো গাছের গুঁড়ি। শালের গাছে এসেছে ন্তুন পাতা। কৃষ্ণচূড়ার গা বেয়ে উঠেছে বড় বড় পাতাওলা পরগাছা।  মাঝে মাঝে গজিয়ে আছে  নয়নতারার ঝাঁক। টবের মধ্যে পাতাবাহার, একটু এগিয়ে ক্যান্টিনের সামনে একটা নাম না জানা গাছ, তাতে  শীতের শেষে ফুটবে হালকা বেগুনী রঙের  ফুল। পালকের মতো নরম; গোছায় গোছায় ঝরে পড়ে থাকবে রাস্তার ওপরে। পলাশের গাছে যেন আগুন লেগে গেছে। কৃষ্ণচূড়ায় আসবে আসবে করছে লাল- হলুদের বাহার।
লাল রাস্তায় পড়ে আছে শুকনো পাতা, পায়ে লেগে মচ-মচ করে উঠছে। শনিবার রাস্তায় ঝাঁট পড়ে না। চারপাশে কেও কোথাও নেই, এমনকি কুকুর ছানাগুলোও বেপাত্তা।  একটা কোনো পাখির আওয়াজ আসে।  ল্যাবের বাইরে নেশালাগানো ঝিমধরা দুপুর। আস্তে আস্তে রোদ নেমে আসে। ওয়ার্কশপের পাশে ল্যাবের ওপরে লাল রঙের অস্তগামী সূর্য।
আমাদের এরকমই ভালো লাগে। শান্ত, অলস, ব্যস্ততাহীন, অগোছাল চারপাশ। ধুলোজমা বারান্দার রেলিং,নীচে পড়ে থাকা না ব্যবহার সাইকেল। ডাঁই হয়ে থাকা ভাঙ্গা চেয়ার-টেবিল, বড়-বড় কাঠের বাক্স। অনেক আগের ভেঙ্গে যাওয়া ফোয়ারা, ইটের উপরে ইট সাজিয়ে বানানো হয়েছিল গোল বসার জায়গা; সব ঢেকে গেছে আগাছায়। কেয়ারী করা বাগান ভরে গেছে বড় বড় ঘাসে, তাতে সেপ্টেম্বরের শেষে প্রজাপতির ঝাঁক খেলা করবে। তার এখনো অনেক দেরী। এখন আমগাছ ভরে উঠেছে মুকুলে,তাতে বিকেলের মরা আলোতে উজ্জ্বল হলুদ আভা। এখন সব কিছু অগোছাল মায়ায় ভরা মতন, আনমনা। ছাদের উপরে ট্যাঙ্কির কল থেকে টপ টপ করে পরা জলের ফোঁটার মত আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে সময় বয়ে যায়। পাশে বসে থাকা মুখ বদলে যায়, শুধু শনিবারের দুপুর স্থির হয়ে থাকে,বছরের পর বছর।



Thursday, February 2, 2017

বইমেলা ২০১৭

বইমেলা যখন ময়দানে হত, হাতে গুনে দু-তিন বার গেছিলাম। বইমেলা তারপর চলে এল বাইপাসের কাছে, মাঝের এক বছর সল্টলেকে হল। কাছে হয়ে যেতে আমি নাচতে নাচতে গেলাম। স্কুল- কলেজে বই কেনার থেকে বই দেখাটাই বেশী হত। পড়ার জন্য লাইব্রেরী ভরসা। তবে বইমেলার কল্যাণে বার্ষিক বই কেনার একটা ব্যাপার ছিল।
তারপরে বই কেনার ফ্রীকুএন্সি বেড়েছে (পড়ার কতটা বেড়েছে জানি না)। সারাবছর বাড়ীতে বসে ইন্টারনেটে বই কেনা হয়। বইমেলার উপরে নির্ভরতা কমেছে। কাজের ব্যস্ততা ও বেড়েছে।  মেলায় যেতে  বইপ্রেমী বা হুজুগে সঙ্গীরও দরকার হয়। সব মিলিয়ে বিভিন্ন কারণে তিন বছর আগে লাস্ট বইমেলায় যাওয়া হয়েছিল।

এবছর না ছিল কাজের ব্যস্ততা। আর "এবছরে না হলে আসছে বছর তো আছে" সেই নিশ্চয়তা কমে এসেছে। তাই দু- তিন দিন ধরে যাচ্ছি- যাচ্ছি করে শেষমেষ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দুপুরবেলা মেলায় উপস্থিত হলাম।
উদ্দেশ্য দুটি---- বই দেখা আর বাংলা বই কেনা।ঘন্টা তিনেকে যা যা দেখলাম তার সংক্ষিপ্তসারঃ

১) রাশি রাশি বইয়ের স্টল---যেরকম থাকে। অনেকগুলোই প্যাভিলিয়নের মধ্যে ভাগ করা। ভীড় আছে তবে থিক থিকে ভীড় নয়। পছন্দ মতো বই হাতে নিয়ে দেখা যাচ্ছে।
২) লোক সঙ্গীত হচ্ছে দুটো জায়গায়, সবাই দাঁড়িয়ে শুনছে।
৩) থিমঃ কোস্টারিকা। সেখানে সেলফি তোলার ভীড় জমেছে।
৪)  বড় বড় ড্রামে খাবার জলের প্যাকেট রাখা আছে।তাছাড়া ফুড কোর্ট আর অন্যান্য খাবারের দোকান তো আছেই।
৫) মেইন অডিতে নবনীতা দেবসেন এবং "সই" এর মেম্বাররা এসেছেন--সবাই নিজের লেখা পাঠ করছেন। হল যদিও প্রায় ফাঁকা।
৬) ছবি-কার্ড- আর অজস্র টুকিটাকি (মায় কানের দুল) বিক্রী হচ্ছে।

আরো ঘটনা ঘটছিল , তবে বই দেখা- কেনার চক্করে ভালো করে লক্ষ্য করতে পারিনি।

বাকি ছবি দিলামঃ
দিনাজপুরের কান্তজী মন্দিরের অনুকরণে বানানো

লোক গান হচ্ছে

সই এর সভা

পট আঁকা হচ্ছে



 লুটোপুটি করে কেনাকাটি
এখন কাকে ছেড়ে কাকে আগে পড়বো সেটা নিয়ে রাতের ঘুম উড়ে যাচ্ছে।


Friday, January 6, 2017

ডায়রি

লাল রঙের ডায়রি ছিল। আর ডায়রি লেখার অভ্যাস ছিল। রোজ নয়, মাঝে মাঝে। খুব অস্থির লাগছে, চিন্তাগুলো কিছুতেই বাগ মানছে না, এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে, তখন খাতা কলম  নিয়ে বসা ছাড়া গতি ছিল না।
একটা একটা করে শব্দ জুড়ে যখন একটা লাইন তৈরী হবে, লাইনের পর লাইন জুড়ে প্যারাগ্রাফ, তার বিষয়বস্ত ু  যতই অকিঞ্চিতকর হোক না কেন, প্রসেসটার মধ্যে মনকে শান্ত করে দেবার অসামান্য ক্ষমতা আছে। সেটা আরো বুঝলাম যখন অসুখ হয়ে  আগের বছর একদম গৃহবন্দী দশা হল। ডাইরি  থেকে ব্লগে উত্তীর্ণ হলাম। ডাইরি  হচ্ছে একদম নিজস্ব, যা নিজেকেও বলতে ভয় পাচ্ছি, তা লিখে রাখা যায়। আর এদিকে ব্লগ হচ্ছে ঠিক তার উলটো।যা ভাবছি সব কিছু উজাড় করে প্রকাশ করাই এর উদ্দেশ্য।  কিছু লিখলে তারপরেই পেজ ভিঊ এর গুনতি শুরু। কিন্তু আমরা কি সব কিছু যা ভাবছি তা বলে উঠতে পারি? কোনটা বলব আর কোনটা রেখে দেব মনের ভেতরে এই দোলাচলই কি কেটে যায়না অনেকটা সময়।
 আমি লিখছিনা বেশ কয়েকদিন হল। এমন নয় যে তার আগে আমি দীর্ঘ সময় লিখেছি, কিন্তু যেটুকু সময় ব্লগ লিখেছি সেটা রেগুলার ছিল। আমি লিখছি না কারণ এখন আমার মাথায় আর কিছু আসছে না। তার মানে কি যে আমার জীবনে ঘটনার অভাব ঘটেছে? তা কিন্তু নয়। বরং আমার ব্লগের সমস্ত লেখা হয়েছে যখন, তখন বাহ্যিক ভাবে  আমার সারাদিন বাড়িতে শুয়ে থাকে ছাড়া কোন কাজ ছিলনা।  যদিও আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম। ব্যস্ত ছিলাম নিজের রাগ, দুঃখ আর ভয় থেকে পালাতে, সাইটোটক্সিক ওষুধের রিয়্যাকশন থেকে নিজেকে আলাদা করতে। আর তখন সেই পালানোর এক মাত্র মাধ্যম ছিল এই ব্লগ। যা মনে এল তাই লিখলাম, জাস্ট লিখে গেলাম---- আর আমার মধ্যের চলতে থাকা অবিরাম অশান্ততাগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে লাগল।
আজকে আমার সত্যি কিছু লেখার নেই।
বছরের সাথে সাথে আমিও বদলে যাচ্ছি, আমার চারপাশটাও বদলে যাচ্ছে, আমার চাওয়া পাওয়াগুলো ও ন্তুন হয়ে যাচ্ছে। তা নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। শুধু এই শব্দ সাজানোর আনন্দটার স্বাদ যেন বদলে না যায়, এই কামনাই করি।