statcounter

Saturday, August 19, 2017

মধুচন্দ্রিমা- পর্ব ২-কাইস মনাসট্রি-জনা ফলস- রোটাং পাস -নগর

সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম কাজ হল বারান্দাতে বেরিয়ে বাইরের পাহাড়গুলো দেখা। রোজ তাদের রূপ বদলায়; একই দৃশ্য তাও যেন নতুনের মতো লাগে। সারারাত বৃষ্টি হয়ে সকালে আকাশ পরিস্কার হয়েছে; সূর্যের আলো পড়েছে পাহাড়চূড়ায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তেজ পাল্টায় , আস্তে আস্তে মেঘ এসে জমা হয় পাহাড়ের মাথায়, নামতে থাকে নীচের দিকে। ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায় চারপাশ; তাতে খুব ভীড়ের মধ্যেও একা লাগে নিজেকে।

আজকে আমাদের যাবার কথা কাইস মনাসট্রি আর জনা ফলস দেখতে। নগর থেকে কুলুর দিকে ১২ কি মি দূরে ছোট্ট কাইস মনাসট্রি। সামনে সবুজে ঘেরা পাহাড়ের সারি দিগন্ত ছুয়ে আছে।লামা কোয়াটারসের পাশ দিয়ে; বাগান পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে উপাসনা গৃহ। বিশাল কাঠের দরজা আর লাল পরদা দেওয়া জানলাওলা ঘরে হাজার রকম তিব্বতী দেবতা আর বুদ্ধের অবতারের ছবি এবং মূর্তির সমারোহ। তার মাঝে স্মিত মুখে তথাগত বসে আছেন। সামনে দলাই লামার হাসি মুখ। আমরা এসেছি পুজোর সময় পেরিয়ে, তাই এখন ফাঁকা। বেরনোর সময় বোঝা গেল এটা আসলে লাঞ্চ টাইম-- কিচেনের সামনে সবাই ভীড় করে আছে; হাসি হাসি মুখে ম্যাগি ভরতি বাটি নিয়ে ফেরত যাচ্ছে বাচ্চা লামারা। দেখা হল নানা সাইজের পোষ্যদের সঙ্গে; তারা ল্যাজ নেড়ে নেড়ে চলেছে লামার পেছন পেছন; অথবা শুয়ে আরাম করছে।





এবার যাত্রা শুরু জনা ফলসের দিকে। কাইস থেকে নগর পার হয়ে আরো ওপরের দিকে জনা ফলস। লোকালয় পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ী চলল। জায়গায় জায়গায় রাস্তা ভাঙ্গা, ভিজে মাটি; গাছের পাতায় ঢাকা। গাছেরা একে অন্যের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঝুপ্সি হয়ে আছে মাথার ওপরে। বৃষ্টি পড়ছে ঝিমঝিমিয়ে; গাছের মাথার ওপরে জমে আছে তুলো তুলো মেঘ; নিজের ইচ্ছে মতো ভেসে যাচ্ছে এদিকে থেকে ওদিকে; এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে। এরকম ভাবে ১ ঘন্টা মতো চলার পর আমরা পৌছালাম জনা ফলসে। রাস্তার দুদিক দিয়ে ধাপে ধাপে নেমে গেছে সরু ঝর্ণা নেমেছে; স্রু কিন্তু বর্ষায় বেগবান। 




জনা ফলসের আকর্ষণ দুরকম ; অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়দের জন্য ভ্যালী ক্রসিং আর সবার জন্য হিমাচলী খাবার। চার পাঁচটা ছোট ছোট ঝুপড়ি; তাতে কাঠের জ্বালে রান্না হচ্ছে। আমরা দৌড়ে গিয়ে সব চেয়ে শেষের খাবারের দোকানেটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। রাস্তা থেকে কিছুটা উঠে গিয়ে একদম  ঝর্ণার সামনে একটা বড় পাথরের উপরে খেতে বসার জায়গা। এখানে না বসতে চাইলে একটু নীচে নেমে আরো একটা পাথরের চাতাল; তার মধ্যে দিয়ে জল যাচ্ছে--- সেখানেও চেয়ার-টেবিল পাতা। বৃষ্টি না থাকলে ওখানে বসে থাকা যায় জলে পা ডুবিয়ে। আমরা ওপরের বসলাম;  হিমাচলী থালিতে এল;   লাল চালের ভাত; মকাইএর রুটি, সিদ্ধু (এপ্রিকটের পুর দেওয়া ঝাল পিঠের মতো) ঘি, বেসনের কাঢ়ী, রাজমার ডাল,  লিংরি নামের ফিড্লহেড ফার্নের তরকারি;  ঝাল আচার আর গুড়। বৃষ্টিতে লোকের ভীড় নেই বললেই চলে; জল পড়ার  শব্দ আর পাখির ডাক ছাড়া আশেপাশে কোন শব্দ নেই ; সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল সময় যেন থেমে গেছে ।ওখানে ঘন্টা দুয়েক কাটিয়ে আমরা ফিরে আসলাম হোটেলে।




পরের দিন যাবার কথা 50 কি মি দূরে রোটাং পাস দেখতে (উচ্চতা  3978 মিটার; মানালীর প্রায় দ্বিগুণ)। মানালী থেকে সব্বাই যাচ্ছে রোটাং এ আর তাই নাকি সাঙ্ঘাতিক জ্যাম রাস্তাতে। জ্যামের ভয়ে আলো ফোটার আগেই বেরনো হল হোটেল থেকে। গাড়ী চলেছে ঘুমন্ত শহরের মধ্যে দিয়ে। আকাশের রং আস্তে গাঢ় নীল থেকে হাল্কা নীল হল; তাতে ফুটে উঠল লালের ছোঁয়া, ভোর হল। নেহেরু কুন্ড পেরিয়ে; সোলাং ভ্যালীকে বাঁ পাশে রেখে আমরা চললাম। মাঝে গুলাবাতে চেক পয়েন্টে দাঁড়াতে হল; লম্বা লাইনের পেছনে। রাস্তা দিয়ে নানা সাইজের গাড়ি ছাড়া চলছে হিমাচল ট্যুরিজমের বাস; বাইক যাচ্ছে রোটাং পেড়িয়ে কেলং বা লেহতে। গুলাবার পরে আর কোন স্টপেজ নেই--- হু হু করে পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে গাড়ি উঠছে, পাশে দৃশ্যের পর দৃশ্য পরিবর্তন হচ্ছে। শুরুতে বড় বড় গাছ, সবুজ পাহাড়; তার বুক চিরে তিরতির করে নেমেছে নাম না জানা ঝর্ণা, বয়ে চলেছে গিরিখাতের দিকে। যত ওপরের দিকে উঠছি গাছের সংখ্যা কমে আসছে, পাথরের গায়ে সবুজ কার্পেটের বিছানা; আরো ওপরে একদম ন্যাড়া পাহাড় । সকালে যখন বেড়িয়ে ছিলাম তখন বুঝিনি, গুলাবা পার হয়ে কিছুদুর পরে আমাদের সঙ্গ নিল মেঘ আর বৃষ্টি। চারপাশ ঢেকে গেছে ধোঁয়াধোঁয়া মেঘে; দৃশ্যমানতা একদম কম; তার মধ্যে হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ী চালাতে হচ্ছে;আমরা কাঠ হয়ে বসে আছি।  এরকম ভাবে মেঘ জমা আর মেঘ কাটার মধ্যে দিয়ে আমরা পৌছালাম জীরো পয়েন্টে । সেখানে তখন বৃষ্টি নেমেছে; পাঁচ লেয়ার গরম জামা ভেদ করে হিম করে দিচ্ছে হাওয়াতে।   সবাই এর মধ্যেই বরফের ওপরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে; অনেকে এতো ওপরের  দিকে উঠে গেছে যে রাস্তা থেকে দেখাই যাচ্ছে না। ঠান্ডাতে আর হাইট সিকনেসে আমার তখন ছেড়ে দে মা অবস্থা। তাই বিয়াস কুন্ড না দেখেই আমরা নেবে এলাম; রোটাং এ আমাদের কোন ছবি তোলা হল না। ফেরার সময় দেখা পেলাম রোটাং এর বিখ্যাত জ্যামের---পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে  কয়েক কি মি ধরে গাড়ীর লাইন; একচুল করে নড়ছে। আমরা হোটেলে ফিরলাম দুপুর দুটোতে।

                                      






                                   
জীরো পয়েন্ট


ফিরে এসে ট্রাউট ফিশ দিয়ে লাঞ্চ

নগর ক্যাসেলের পাশেই আছে রাগিণী ক্যাফে; তারই অংশ লাভাজা। রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা ওপেন ক্যাফে। হানি-জিঞ্জার-লেমন টী আর এপ্রিকট কেক দিয়ে বিকেলের খাবার হল। একগাদা আদা ভেজান গরম জলের মধ্যে লেমন টী এর ব্যাগ ডুবিয়ে চা তৈরী হয়ে গেলে মেশাতে হবে আপেলের ফুলের মধু। আমার সকাল  সন্ধে চা লাগে--- আমার কাছে তো এই বস্তু অমৃত সমান। আর আমার সঙ্গী যিনি মাসে দুবার চা খান কিনা সন্দেহ সেও খেল--দুবার অর্ডার দিয়ে।
হানি-জিঞ্জার-লেমন টী

রাতের খাবার

অন্যদিনের মতো আজও রাতে ক্যাসেল নিস্তব্ধ। সামনে পাহাড়ে জোনাকীর আলো; চারদিক ভরে আছে শব্দহীন নিশ্চিন্ততায়, দিন আসে--দিন যায়;   কিন্তু এই  দৃশ্য বদলায় না; বিয়াসের পাশে গড়ে ওঠে ঘরবাড়ি; আপেল বাগান কেটে হোটেল ওঠে--- তার মধ্যে সামনের পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকে---অনন্তকাল ধরে।
পরদিন যাবার কথা সোলাং ভ্যালীতে (চলবে)।