statcounter

Thursday, June 30, 2016

জন্মদিনের পোষ্ট- একত্রিশে পা

হৈ হৈ করে চলে এল ২৯ শে জুন। লাফাতে লাফাতে পা দিলাম একত্রিশে। নানা ঝড়ঝাপটা সামলে তিরিশখানা বছর মানে প্রায় অর্ধেক জীবন উতরে গেল , ভেবেই আহ্লাদে লুটোপুটি।
আর হবেই না বা কেন . সেই ছোটবেলা থেকে হাজার রকম মন খারাপ, জ্বর, পেটব্যাথা, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, পি এইচ ডি এন্ট্রান্স এমন কি বাধ্যতামুলক পেপার ছাপানো (নইলে থিসিস জমা পড়বে না)  এবং এগুলোর থেকেও কঠিন; নাহওয়া প্রেমে লেঙ্গি আর  হব হব প্রেমে ব্রেক আপ (আসলে পুরোটাই ঢপবাজি, তবে সে এখন সুখী গৃহকোণে পাড়া মাতিয়ে ঝগড়া করছে; ভাবলেই মন ভাল হয়ে যায়)--- সব সাঙ্ঘাতিক সাঙ্ঘাতিক ফাঁদ কাটিয়ে একত্রিশে পৌঁছে গেলাম। সেলেব্রেশন তো মাংতা ই হ্যায়।

কি কি হল??

১) বন্ধুরা এল। কেউ সারপ্রাইজ দিতে অন্য শহর রাতারাতি উড়ে, বাকিরা আগে থেকে জানিয়ে বা না জানিয়ে। সারাদিন আড্ডা হল। এক গাদা গিফট পেলাম--ছবি দিচ্ছি।

বই -কার্ড আর ফাইটার ফিশ ( নাম হয়েছে ঢোলু) বাকি গিফট পেটে গেছে

২) দু খানা কেক কাটলাম। সবাই হ্যাপি বার্থডে গাইলো--হেসে হেসে গড়ালাম।


৩) সারাদিন হি হি করে রাতে জ্বর এসে গেল।। তবে একটা ওষুধেই পালিয়েছে।

৪) একগাদা ফোন আর মেসেজে আড্ডা হল যারা এখানে নেই আর চাইলেই চলে আসতে পারছেনা তাদের সঙ্গে।


কি কি হলনা??

নাকুচিয়াতালের পাশে কে এন ভি এন এর হোটেলে বসে নীলজল দেখতে দেখতে চা খাওয়া হল না। প্ল্যানে ছিল কিন্ত ু ভগা হাসলেন। কুছ পরোয়া নেই--- অন্য সময় হবে।

বাকি মজা পরের বছরের জন্য তুলে রাখলাম , পরের বছর আজ থেকেই শুরু।

জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় (অর্ধেকের কম হলে আরো ভালো) কাটিয়ে এটাই বুঝলাম যে, 

১) একটু চোখ খোলা রেখে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাতে অনেক ঝামেলা কমে। 

২) ভাল সম্পর্কের কোনো বিকল্প নেই--সেই তা বাবা মা হোক, আত্মীয় হোক বা বন্ধ ু। রিলেশনশিপস আর দ্য বেস্ট ইনভেস্টমেন্ট।

৩) আর দুশ্চিন্তা হল সময়ের অপব্যবহার (গুণীরা আগেই বলেছেন)।

যাই হোক ভারি কথা বলে সময় নষ্ট করবো না আর। মেনু বলি বরং। বিরিয়ানি আর চিকেন চাপ আর পায়েস। খাবার দেখেই প্লেটে ডাইভ মেরেছিলাম তাই ছবি নেই ।


আমরা সবাই

 বাই দ্য ওয়ে, গতকাল নতুন বাড়ীতে এসে ঢোলু একটু মনমরা ছিল। আজকে দিব্যি একা একা খেলা করছে। 







Tuesday, June 28, 2016

১৪ ই জুন (মঙ্গলবার) দিনটা

তিন মাস বাড়ীতে বসে থাকলে আর তিন মাসে গুনে গুনে ১১ দিন বাড়ী থেকে বেরনো হলে অন্য লোকদের কি হয় আমি জানি না। তবে আমার যেটা হল তাকে পাতি বাংলায় বলে ডিপ্রেশন।

ডাক্তারবাবু আগেই একটা ভারি নামওলা বলেছিলেন  --- anticipatory anxiety. তবে সবাই হাসল---এতো পরীক্ষার আগে সবার হয়েছে। আমি হাসলাম না তবে জেদ ধরে রইলাম যে ফালতু ঘুমের ওষুধ খাব না। বার দুয়েক ছড়িয়ে ফেলার পর সেটা কেটে ও গেল। আর তার ভাই এসে হানা দিলেন।
অকারণ রাগ আর অকারণ কান্না-- দুটোই বিয়ন্ড কন্ট্রোল। তখন নতুন ওষুধ ঠিক হল--- বেড়োনোর মহৌষধী।

তাই সেজে গুজে একটা মেঘলা মঙ্গলবার বেড়িয়ে পড়া গেল।
প্রথমে খাদ্যানুসন্ধান, তার জন্য অবশ্য জোমাটোই কাফি। বাড়ির কাছে অতি পুরোনো হাটারির অপেক্ষাকৃত নুতন রেস্টোর‍্যান্টে গিয়ে লাঞ্চ করা গেল। হাটারিতে বহুকাল আগে খেয়েছিলাম, কিছুই মনে ছিলনা খাবারের সম্বন্ধে-- দেখা গেল দুজনের জন্য অপর্যাপ্ত অর্ডার হয়েছে---কিছুটা বাড়ী নিয়ে যেতে হল।
চিকেন ইন সুইট অ্যান্ড সাওয়ার সস (Chicken in sweet and sour sauce)

মিক্সড মেইফুন (Mixed meifoon)

লাঞ্চের পরে কি হবে সেটা নিয়ে সন্দেহ ছিল। দৌড়ে বাড়ী নাকি ভ্রমণ ! দেখা গেল ওয়েদার এবং বাকি সব কিছু ভ্রমণের পক্ষে রায় দিচ্ছে।
ড্যানিশ লেখক আইজাক ডিনেসিনের মত মেনে  " The cure for anything is salt water: sweat, tears or the sea" যদি সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে পা দোলানো যেত তাহলে আমার অশান্ত মনের শান্তি  হত পুরোপুরি। কিন্তু তার যখন উপায় নেই, তখন গঙ্গার ঘাটই ভরসা। তাই যাওয়া হল আদি অকৃত্রিম বাগবাজারের মায়ের ঘাটে।

কলকাতার এই জায়গাটা বেশ অন্যরকম , অন্তত আমার চোখে। ট্রেনলাইন পার হয়ে ঘাট। তাতে বসে আছে বিভিন্ন বয়সি মানুষ জন। ছবি আঁকা ছোকরা, দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গল্প করা জুটী, গঙ্গা জল নিতে বা নিত্যদিন ঘাটে গল্প করতে আসা বয়স্ক লোকজন, স্নানার্থী এবং জলে ঝাঁপ দিয়ে পয়সা খোঁজা ছেলে এবং সেলফি শিকারীর জমায়েত হয়েছে। তার মধ্যে গিয়ে আমরা ঘাটের উপরে বসে পড়লাম। আর অপার শান্তি। বিকেলে পড়ন্ত আলোয় চিক চিক করছে জল- তাতে সোনালী রঙের ছোঁয়া। জলে ছোট ছোট নৌকো ভাসছে, আপাতত তাদের কোথায় যাবার তাড়া নেই। একটা  মাল ভর্তি স্টিমার ভেসে গেল। নদীর উলটো দিকে বড় বড় গম্বুজের মতন দেখা যাচ্ছে--সেটা কি আমি জানি না।
                               



কিছুক্ষন জলের দিকে তাকিয়ে মনের ক্লান্তি ধুয়ে দেবার চেষ্টা করা গেল। আমাদের পাশে বসে থাকা ভদ্রলোক জোয়ার ভাঁটার খবর দিতে লাগলেন। এরকম সময়ে  মুর্তিমান রসভঙ্গের মতন দুই ভদ্রলোক হাজির হলেন হাতে প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট নিয়ে। তাদের দেখেই ঘাটে বসে থাকা এক্সপিরিয়েন্সড লোকের এখানে প্যাকেট ফেলা মানা আছে বলে চেঁচাতে শুরু করল। তারাও আমরা লোকাল লোক সব জানি, বলে দাবী করলেন। শেষে একজন রণে ভঙ্গ দিয়ে প্যাকেট যথাস্থানে আর আরেক জন "মানছি না মানব না' করে প্যাকেট জলে ফেললেন। বাকিরা দু চারটে কড়া কথা বলে নিজেদের কাজে মনোনিবেশ করল। আমরা ও ঘাট ছেড়ে কফির খোঁজে বেরোলাম।

বাগবাজারে CCD পাওয়া গেল না। অটো স্ট্যান্ড থেকে বলল শ্যামবাজার। শ্যামবাজারে গুগল ম্যাপ বলল ফড়িয়াপুকুর। আমার পক্ষে পাঁচ মাথার মোড় থেকে অদ্দুর হেঁটে যাওয়া দুরস্ত, তাই হাতে টানা রিক্সা নেওয়া হল। একটা মানুষের ঘাড়ে ( পরুন হাতে) এরকম দুজন পুর্নবয়স্ক লোকের চেপে বসার গ্লানিটা অগ্রায্য করলাম বাধ্য হয়ে। যদিও সাইকেল রিক্সাতে সব সময় চড়ছি, তাতে কোন লজ্জা বোধ করিনা।  হাতে টানা রিক্সাতে চড়া সহজ ব্যাপার নয়, চাপিয়ে দিয়ে  যখন রিক্সাজ্যেঠু যানটিকে হাতে তুলে নেন , তখন মনে হয়  পেছন দিয়ে উলটে যাব। নামার সময়ও সামনে দিয়ে গড়গড়িয়ে পপাত চ হবার সম্ভাবনা থাকে।  আমরা সেই রিক্সাতে প্রান হাতে নিয়ে বসে রইলাম আর বাস, ট্রাম, সাইকেল সব কাটিয়ে রিক্সাজ্যেঠু ছুটতে লাগলেন। 

হাতে টানা রিক্সাতে এর আগে জীবনে একবারই চড়েছি, এম জি রোড থেকে হাওড়া ব্রিজ পর্যন্ত ।  যাত্রা সেভিং রিক্সা না থাকলে সেদিন সবাই হাতিয়া এক্সপ্রেস চড়ে নেতারহাট পৌঁছে যেত আর আমি পরে থাকতাম কলকাতায়। তাই এর প্রতি আমার কৃতজ্ঞ্তা প্রবল। আমার সহযাত্রীর সেদিন এতে হাতেখড়ি হল, সেও সমান খুশী ও উত্তেজিত। ফড়িয়াপুকুর গিয়ে বোঝা গেল ম্যাপ বুঝতে সামান্য ভুল হয়েছে-- CCD  টি রাজা দিনেন্দ্র স্ট্রীটে, সেটা রাস্তার উল্টোদিক।
আরো কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি এবং লোকজন কে জিজ্ঞেস করার পরে (CCD কেউ চেনে না, তবে একজন বললেন এই রাস্তাই ঠিক যদিও গন্তব্য সম্বন্ধে তিনি অজ্ঞ) অটোতে ওঠা ঠিক হল। এবং সমাপতনের মত  কফিশপ পৌঁছে গেলাম। এর পরে আর কিছু নেই। খেয়ে দেয়ে ট্যাক্সি করে বাড়ী ফেরা হল। 















Saturday, June 25, 2016

অ্যান ইউসুয়াল ল্যাব আউটিং (An usual lab outing)

এরকম বহুবার হয়েছে লাষ্ট ৬ বছরে, কিন্ত ু তখন ব্লগ ছিলনা তাই লেখার প্রয়োজনও ছিলনা। আর তখন এই ল্যাবের দিনগুলো দ্রুত বেগে শেষ হয়ে যাচ্ছিলনা। তাই এটা একটা এসেনশিয়াল ল্যাব সংক্রান্ত পোষ্ট, যেটা পড়ে ভবিষ্যতে আমার লজিক-নষ্ট হবে।

দেশ এবং হয়ত কাল নির্বিশেষে গ্রাজুয়েট স্ট ুডেন্টদের মধ্যে  যা যা মিল পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম হল পারপিচুয়াল হাঙ্গার---- না না জ্ঞানের ক্ষুধার কথা আমি বলছি না। তা নিশ্চয় আছে বেশির ভাগের মধ্যে, সবাই তো আমার মতন নয়। আমি বলছি নেহাতই পাতি শারীরিক ক্ষুধার কথা, যাকে মেটানোর জন্য এত পড়াশুনা, পরীক্ষা দেওয়া, চাকরি করা এবং তিন বেলা পাত পেড়ে খেতে বসা। তবে এই খাবার ইচ্ছেটা অনেক সময় মানসিকও বটে। অনেক সময় বলাভুল কারণ প্রথমত শরীর আর মন দুটো আলাদা একেবারেই নয় আর ভাল খাবার খেলে যে পরিমাণ মানসিক তৃপ্তি আসে, যাকে আজকাল বলা হচ্ছে গ্যাস্ট্রোইনস্টেটিনাল প্লেজার সেটা অতীব সাঙ্ঘাতিক একটা এক্সপিরিএন্স। আর মন ভাল না থাকলে কাজ ভাল কি করে হবে!

তাই  বাইরে খাওয়া চলতেই থাকে, কারণ ক্যান্টীন তো এখন প্রায় বাড়ীর মতন। আর মানুষের তো তিনটে হাত-- ডান, বাম আর অজুহাত। তাই বাইরে খেতে যাবার কারণের অভাবও হয়না কখনো।
এক্সপেরিমেন্ট কাজ করার আনন্দ বা না করার দুঃখ, পেপার পাঠানো, অ্যাক্সেপ্টেন্সের কিংবা রিজেক্টেড হবার সেলিব্রেশন ( বস বলেছে ওয়ান শুড সেলিব্রেট দেয়ার ফেলিওর টূ), অনেক দিন যাইনি, বা আজকে ল্যাব যেতে/ কাজ করতে ইচ্ছে করছে না--খেতে গেলেই হয়----- রিজনের লিষ্টটা এন্ডলেস। আর যেতে না পারলে অর্ডার করলেই হল।

সেই যে ২০১০ এ কাফিলা যাওয়া থেকে শুরু হয়েছিল, সেই ্ট্র্যাডিশন বজায় রেখে, বস সমেত অথবা ছাড়া (কারণ বিভিন্ন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ মিটিং এর ব্যস্ততা); আমরা জয়যাত্রায় যাচ্ছি এরকম হাবভাব নিয়ে ফুড আউটিং চালাতে থাকি। তবে রিসেন্ট ২৯ মে যেটা হল সেটা রু এর অ্যচিভমেণ্টের সেলিব্রেশন--- আর ট্রিটও জয়-অধিকারীনির পক্ষ থেকে। তাই বাকিরা নাচতে নাচতে গেলাম, বস গেলেন না;  হরলিক্সের বাচ্চার মতন  "আমি খুব বিজি বলে"।

যাওয়া হল ল্যাবের কাছেই চাওম্যানে--সেফ, ট্রায়েড অ্যান্ড টেস্টেড। দুপুর ১ টায় পুরো রিক্সাহীন রাস্তায় কিছুক্ষ্ণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে ভগবান প্রেরিত ভাবে একটা ব্যাটারি চালিত রিক্সা- অটোর সংকর বস্ত ুউদয় হল। নাকি পাঁচজন চড়তে পারে--- সাঙ্ঘাতিক ওভার এস্টিমেশন সেটা। তবে যাদের মন্শচক্ষে ৫/৭ মিনিট রিক্সায় ঝোলার ইন্সট্যান্ট রিওযার্ড হিসাবে চাইনিস নাচানাচি করছে , -- তাদের কাছে এ আর এমন কি কঠিন কাজ।

রৌদ্র করোজ্জল দিন  



হাইব্রিড ব্যাটারি রিক্সাতে আমরা


দেখে যতটা সিম্পল মনে হচ্ছে ব্যাপারটা তার চেয়ে জটিল। রিক্সায় দুরকম সিট--- নর্মাল ফর অ্যাডাল্ট আর টাইনি ফর কিডস (মেরে কেটে ১০/১২ বছরের বেশি নয়)। নর্মাল সিটেও আমাদের মতন হেভি ওয়েটদের দুজন ধরে। তাতে ৩ জন আর কিডস সিটে ২ জন (পা বাইরে ঝুলিয়ে বসে রয়েছে)। আর চালাও পানসী থুড়ি রিক্সা চাওম্যান।


বৃথা বাক্যব্যয় করে লাভ নেই, কি কি খেলাম তার ছবি দিচ্ছি।

চিকেন লেমন করিয়েন্ডার স্যুপ (chicken lemon coriander soup)

সি ফুড স্যুপ (sea food soup)

স্টাইর ফ্রায়েড চিকেন (stir fired chicken)
ক্রিপসি কনজী চিকেন (crispy conjee chicken)

চিকেন মোমো (chicken momo)
সিঙ্গাপুর মেফুন আর ফিশ ইন সুইট অ্যান্ড সাওয়ার সস (Singapore meifoon and chicken in sweet and sour sauce)
বেরোনার সময় বৃষ্টি এসে গেল--তাই জি এর আর শর্মা গিয়ে গোলাপ জামুন খাওয়া হল না। অটো করে ল্যাব ফেরা হল।


এত খাবার খেয়ে চা/ কফি না হলে কি করে কাজে মন বসবে।

VECC  যাওয়া হচ্ছে (সাদা জামাতে বস)


মেঘলা বিকেলে  SINP এর গেট

 র‍্যান্ডম
কেউ গেল সাতসমুদ্রের পারে পোস্টার দিতে আর বাকিরা বাড়ীতে বসে পা দোলাল আর ক্যাডবেরি খেল যত খুশী


দিনটা ভালো কাটল। ইউসুয়াল ও ভালো , লম্বা হোমস্টের পরে তো সুপার ভাল।
                                           

Thursday, June 23, 2016

নাইট আউল এবং সাঁতারকান্ড

রাত জেগে থাকার আসল কারণ হচ্ছে ডেডলাইন। কিছুটা নিজের (সময়ের কাজ সময় থাকতে কি আর ভদ্রলোকে করে) আর বাকিটা ওষুধ দিতে না-জানা এবং জানা ডাক্তারবাবুদের ( স্ত্রী- পুরুষ লিঙ্গ ব্যবহার বাঞ্চনীয় নয়)।

কিন্ত রাত জেগে কাজ কতটা হচ্ছে বলা মুশকিল তবে মাথা কদিন ফাঁকা যাবার পরে ব্লগের আইডিয়া এল--সেটাই বা কম কি।  আর  এক সং্কট মুহূর্তে লাফিয়ে ঝাপিয়ে ১০ টা পোস্ট লিখে, রাজ্যশুদ্দু লোক কে মেসেজে, হোয়াটস অ্যাপে, ফেসবুকে দেখো আমি কেমন লিখতে জানি বলে বড়াই করেছি। এখন ১ মাস না যেতেই আইডিয়া নেই , ব্লগ বন্ধ বললে নিজের কাছেই নিজেই হাসির পাত্র হতে হয়।

তাই আইডিয়া আসাটাই সেলেব্রেশনের কারণ।

যাই হোক, ব্যাপার হল রাতজাগা নিয়ে। কিছু লোক রাতে জাগে আর দিনে ঘুমোয়। স্কুল- কলেজে আমি এই দলে পড়তাম না - যেই পড়াশুনা শেষ হল, অম্নি আমার রাত জাগা শুরু হল। এতে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছিলনা, হচ্ছিল বাড়ির লোকের এবং হিতৈষী প্রতিবেশীর। মায়ের নাকি ঘুম হচ্ছে না, যদিও দুজনের ঘর আলাদা। মাঝে মধ্যে উলটো দিকের বাড়ির পন্দার ও মায়ের সমস্যা হচ্ছিল (পন্দার আসল নাম সামান্য আলাদা, তবে আমার সুরক্ষার খাতিরে এই নামটি ব্যবহার করা হচ্ছে। নামকরণকারীঃ সদ্য কথা বলতে শেখা আমার কাকাতুতো ভাই) , যদিও পন্দার ফ্ল্যাট আমার ঘর থেকে প্রায় ১৫ ফিট দূরে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে পন্দার মায়ের অসুবিধাটা আসলে কৌতুহলজাত---"রাত জেগে ল্যাপটপে কি করা হয় " গোত্রের। আমার মায়েরটা দুশ্চিন্তা করার মাতৃসুলভ অভ্যাস এবং দায়িত্ব পালন ছিল। তবে সবার অসুবিধা অগ্রাহ্য করে আমি রাতে জেগে থাকা এবং তার ফলে দেরীতে ল্যাব যাওয়া বজায় রাখছিলাম।
রাত জাগার সপক্ষে যুক্তি ছিল যাদের মুনসাইন হয় তারা নাকি "নাইট আউল"--আর নিজের জন্মের মাস তারিখ তো আমার হাতে ছিলনা। তাই দোষটা আর যারই হোক না কেন--আমার অন্তত নয়।

এভাবে ভালোই চলছিল--কিন্তু এসে গেল পি এইচ ডি র সাঙ্ঘাতিক থার্ড ইয়ার----আর দ্যাখা গেল প্রজেক্ট কিছুই দাঁড়ায়নি। তখন ল্যাবের অলিখিত প্রোটোকল মেনে সাঁতার শিখতে ভর্তি হয়ে গেলাম। সকাল ৮ টায়  ৩০ মিনিটের ক্লাস। স্কুলে থাকতে দুবার ভর্তি হয়ে সুইমার হতে পারিনি (নিজের সুইমার বন্ধ ু কে জলে প্রায় ডুবিয়ে দিচ্ছিলাম) ---এবার সব সুদেআসলে পুষিয়ে নেবো--এরকম একটা মারকাটারি মনোভাব নিয়ে সকাল সকাল উঠে পুল যাওয়া শুরু হল। সাঁতার ভালই হচ্ছিল, ১৫ মিনিট দেরিতে পৌঁছাছিলাম তবে বড় পুলে প্রোমোশন হয়েছিল। ফাঁকিবাজ বলে পরিচিতিও হয়েছিল , তার মানে নোটিশড হচ্ছিলাম। আড্ডাও ভালো চলছিল---  অ দিদি ছিল আর একটা চারবছর বয়সি বন্ধু হয়েছিল। ল্যাব থেকে অ এবং ন দিদিও  সাঁতার যেত--তারফলে কাজের মধ্যে ফাঁকা সময়গুলো রোজ কে কি ভুল করল, কতটা পারল, গভীরে গেল নাকি হাঁটুজলে হাবুডুবু খেল, পা নড়ল নাকি হাত, ডুবে গেল কিনা এই আড্ডা চলত সারাক্ষন। আর হত ইউটিউব দেখে প্রাইভেট টিউশন নেওয়া। এই সাঁতারের চক্করে রাতজাগা মাথায় উঠে গেল। বাড়ী ফিরে বেলা ১০.৩০ এর মধ্যে ল্যাব যাওয়া শুরু হল এবং কপিবুকের মতন এক্সপেরিমেন্টরা রেজাল্ট দিতে শুরু করল। শেষে বস ডেকে ঘোষনা করলেন রাত জাগে শুধু চোর, আর ভুতেরা (কপিরাইট- বসের বাড়ীর লোকের)---আমার যে সাঁতারকালীন উন্নতি ঘটেছে তাতে উনি বেজায় খুশী।

ঠিক তার ১৫ দিনের মাথায় ইনফেকশন হতে হাত ফুলে সাঁতার যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল সেবারের মতন। এই অসুখ খুব ভুগিয়েছিল, মাস খানেক ল্যাব কামাই হয়েছিল--তবে তা অন্যগল্প। 

আমি আবার আগের রুটিনে ফেরত চলে গেলাম--- ভুত আর চোরের সাথে রাত জাগতে থাকলাম।

বি দ্রঃ পোষ্টটা রাতে লেখা শুরু হয়েছিল, কিন্ত ু ডেডলাইন চক্করে  লেট হয়ে গেল।

সবাই ভালো থাকবেন, দিন কিংবা রাত যখন জেগে থাকতে ভালো লাগে সেটাই করবেন---পন্দার মায়ের অসুবিধার তোয়াক্কা করবেন না (নিজের মায়েরটা করতে পারেন )।







Sunday, June 19, 2016

সান ডে ব্ল ু স এবং চকোলাট

কোনো কোনো দিন এরকম হয়। জীবনে সব না কাটাতে পারা ছুটির দুঃখ ঝপাঝপ মনে পরে যায়। কে কবে পেন্সিল নিয়েছিল, ফেরত দেয়নি; ক্লাস ফাইভে কে জিভ ভেঙ্গিয়ে ছিল; কোন বিয়েবাড়ীতে   সম্পর্কে সুতো এতই জট পাকানো যে আগামাথা হারিয়ে গেছে, সেরকম কেউ বলেছিল এম্মা মেয়ে দেখতে তেমন সুন্দর হয়নি,তাই না; এইসব অকিঞ্চিতকর কথা যেগুলো মনের মধ্যে ডুবে ছিল , সারাশব্দহীন ভাবে, তারা হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উপরে ভেসে উঠে ইলিবিলি কাটতে শুরু করে দেয়।

তখন বাকি দুঃখগুলোও জেগে ওঠে। যে ঘটনাগুলো এখনো ঘটেনি সেরকম দুঃখ-ভয়-রাগরাও লাফাতে শুরু করে দেয়। "পজিটিভ জিনিসগুলো দেখো" এই জাতীয় কোনো প্রয়োজনীয় সদুপদেশ কাজে আসেনা।

তখন হাও মাও করে চেঁচানো ছাড়া মুক্তি নেই।




চকোলাটঃ

http://www.imdb.com/title/tt0241303/




Storyteller: Once upon a time, there was a quiet little village in the French countryside, whose people believed in Tranquilité - Tranquility.

Storyteller: If you lived in this village, you understood what was expected of you. You knew your place in the scheme of things. And if you happened to forget, someone would help remind you.

Storyteller: In this village, if you saw something you weren't supposed to see, you learned to look the other way. If perchance your hopes had been disappointed, you learned never to ask for more. So, through good times and bad, famine and feast, the villagers held fast to their traditions. Until, one winter day, a sly wind blew in from the North...
সেই উত্তরে বাতাসের পথ ধরে গ্রামে এলেন জুলিয়া বিনচ (অনস্ক্রীন নাম ভিয়েন), সাথে ৬ বছরের মেয়ে আনুক। খুলে বসলেন একটা চকোলেটের দোকান, আর আস্তে আস্তে বদলে গেল গ্রামের লোকদের জীবন।

ভাল গল্প---- রুপকথার  মত "যার  শেষ ভাল , তার সব ভাল " দিয়ে শেষ।
না দেখলে একটা "ফিল গুড" মুভী মিস।






Thursday, June 16, 2016

চা- কফি- ইত্যাদি

সারাক্ষণ মনটা চা চা করত। ল্যাব থেকে তিনবেলা ক্যান্টিনে চা খেতে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। সকাল ১১ টা, দুপুর ৩ টে আর বিকেল ৬টা । এই সবগুলোতে  সব সময় পার্টিসিপেট করা যেত না, কারণ কাজের সময় সবার আলাদা আলাদা। ক্যান্টিনে চা এর টাইম ও বাঁধা, তাদের আরো রান্না-বান্না আছে। বাকি সময় চা খেতে হলে কিয়স্ক ভরসা। লেবু চা, লিকার বা নেস কফি। তার সঙ্গে কিয়স্কের ছেলেটার (যার নাম সোম)  বকবকানি ফ্রি।
" কাজ করে কি হবে, সেই তো সাত বছর লাগবে।" ইত্যাদি ইত্যাদি।
আর যখন ল্যাবে এত কাজ পড়েছে যে বেরনোর উপায় নেই, তখন ল্যাবেই আসত চা কিয়স্ক থেকে। তবে সেটা সহজ ব্যাপার নয়-- ফোনে অর্ডার দাও , তারপর অপেক্ষা কর--- এবং শেষে "নেহাত  ক দিদির ল্যাব তাই দিয়ে গেলাম, নইলে আমি খুব বিজি।"  


ক দিদি ক্যান্টিনে হামলা করেছে


ক্যান্টিনে চা এবং টা


                                           কিয়স্কে আমরা---তখনো ছোটো ছিলাম (২০১০)


শনিবার ২টোর পরে ক্যান্টিন -কিয়স্ক দুটোই বন্ধ। তখন হয় পাশের ভি ই সি সি তে যাও অথবা খালপাড়। খালপাড়ে গেলে অবশ্য জিলিপি আর সিঙ্গারা খাওয়া যেত। অথবা রাস্তার মোমো বা ঝালমুড়ি। আর যখন বেরনোর একদম ইচ্ছে নেই কিন্তু চা না খেলে বাঁচব না, তখন ইলেকট্রিক কেটলি আর টী ব্যাগ ভরসা।



                                                            ল্যাবের ইলেকট্রিক কেটলি

কিন্তু জীবনে কোনো সুখই চিরস্থায়ী নয়,এই কথাকে সত্যি প্রমান করে কেটলি ভেঙ্গে গেল একদিন আর কিয়স্কও উঠে গেল। তখন চা এর জন্য টাইম বেঁধে গেল। সেই টাইমের বাবু হয়ে চলছিল। বসের মুখে হাসিও ধরছিল না, কিয়স্ক উঠে গিয়ে নাকি আমাদের আড্ডা কমেছে, কাজের সময় বেড়েছে।

এরকম মাস খানেক চলার পরে এল সুখবর। ভি ই সি সি তে CCD র স্টল খুলছে। গদি আঁটা চেয়ারওলা, এ সি লাগানো,  ৬০ টাকা কফি তে ২০ টাকা ট্যাক্স বসানো CCD নয়।  একটা কাঠের বাক্সের মধ্যে টেবিল পেতে কফি বানানোর মেশিন রাখা। মেশিনের মাথায় গোল ট্রান্সপ্যারেণ্ট জার বসানো। জারের মধ্যে CCD লেখা প্যাকেট খুলে কফিবীন ঢেলে মেশিনের সুইচ টিপে কফি বানিয়ে CCD লেখা কাগজের কাপে করে দিচ্ছে-- ১০ টাকায় ছোট কাপ, ২০ টাকায় বড়।
শুধু তাই নয়, স্যুপও আর আসাম টীও বানিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে আরো কুকিস আর মসলা মুড়ি, কেক হেনতেন। কদিনের মধ্যে ফ্রিজের আমদানী হল, দই, লস্যি ইত্যাদি রাখা শুরু হয়ে গেল। এই স্টল সকাল থেকে বিকেলে ৬.৩০ অব্দি খোলা, মাঝে খালি ৩০ মিনিটের লাঞ্চ ব্রেক। আমরা হাতে চাঁদ পেলাম আবার। দুপুর ৩টেয় ক্যান্টীন কে ডিচ করে CCD যাওয়া নিয়ম হয়ে গেল। দল বেঁধে OC ল্যাব কফি ট্রিপ--বসও ইনক্ল ু ডেড ।


                                                                কফি-আসাম চা- স্যুপ


কিছুদিন পর ভি ই সি সি কর্তৃপক্ষের মনে হল এই CCD এর জন্য তাঁদের সুরক্ষাব্যবস্থার ক্ষতি হচ্ছে। দুটো ইন্সটিট্যুটের মাঝের কমন রাস্তার পাহারা জোরদার হয়ে গেল-- আই কার্ড না দেখিয়ে ঢোকা বন্ধ।
সেই সময় আই কার্ড  ভুলে গেলে বর্ডারে দাঁড়িয়ে কফি/চা য়ের অপেক্ষা ছাড়া গতি ছিলনা।
এখন অবস্থার উন্নতি হয়েছে--নাম লিখলেই আপাতত চলছে। জানিনা আবার কবে নিয়ম  বদলে যায়।


                                                               বর্ডার এরিয়া ( ছবি ১ )


                                                                   বর্ডার এরিয়া ( ছবি ২ )

আমাদের এই CCD প্রীতিতে সাহা ক্যান্টিনের লোকেরা শুরুতে বেজায় অভিমান করেছিল, সময়ের সাথে সাথে তার প্রশমন হয়েছে। আমরা আস্তে আস্তে একুল- ওকুল বজায় রাখতে শিখে গেলাম।

ভি ই সি সি তে CCD র  ফ্লারিশড বিজনেজ দেখে আমাদের ক্যান্টিনে একটা মেশিন বসে গেল। ভি ই সি সি র   ছেলেটি এসে নতুন লোককে কফি বানানোর ডেমনস্ট্রেশন দিয়ে গেল----- কিন্তু আমরা কফি খেয়ে মুখ বেঁকিয়ে বললাম-- হয়নি হয়নি ফেল। দুটো লোক বদল হল, তারপর একদিন বাক্স বন্দি হয়ে কফি মেশিন বাড়ী চলে গেল। এর কারণ অ্যানালিসিস করতে গিয়ে ভি ই সি সির ছেলেটির হাসিমুখ আর উদার হস্তে খুচরো দেবার ক্ষমতার জন্য ওকে অনেক বেশী নম্বর দেওয়া হয়েছিল।সাহা ক্যান্টিনের লোকটাকে কম নম্বরের কারণটা নিতান্তই শিশুসুলভ--- তাই এখানে আর বল্লাম না।

আমরা  ভি ই সি সি গিয়ে রোজকার মতন গুলতানি করতে লাগলাম। ছেলেটি আজকে ম্যাডাম ( বস যেদিন আমাদের ছেড়ে গিয়ে একা কফি খায়) এইমাত্র এসেছিলেন বলে আমাদের গসিপের জোগান দিতে থাকল।



                                                       OC ল্যাব ইন CCD ( ছবিতে  OC নেই )

  

Monday, June 13, 2016

চাঁদের বুড়ী

খুনখুনে বুড়ী থাকে একলা সমুদ্রের ধারে, বাড়ী আর উঠোন। পেছনের পাঁচিল এর ধারেই সমুদ্র। বুড়ীর বয়সের গাছ পাথর নেই। জেলেরা আসে মাছ ধরে, বুড়ীকে দিয়ে যায়। বুড়ী খুশী হয়, হাসে ফোকলা মুখে। শহরে কোনো নতুন বাচ্চা জন্মালে বুড়ীর ডাক পরে বাচ্চার নামকরণ করতে। বহু বছর ধরে চলে আসছে এই নিয়ম। এই শহরে মানুষের জন্মদিন পালন হয়না, গাছের হয়। কিন্ডারগার্টেনের চেরী গাছের জন্মদিনের দিন শহরে হয় উৎসব। শহর সেজে ওঠে সেদিন। সব গাছে লন্ঠন ঝোলানো হয়। গান  হয়, নাচ  হয়, সবাই খাওয়া দাওয়া করে। বুড়ী গোলাপী জামা, সাদা জুতো পরে আসে। সঙ্গে আনে কাপড়--- জড়িয়ে দেয় চেরী গাছের গায়ে---জন্মদিনের অপরিহার্য অঙ্গ।

চাঁদের বুড়ী চরকা কাটে সামনে তুলোর রাশি
জোৎস্না রঙের কাপড় দেখে তার মুখে ফুটছে হাসি। 
বুড়ী তোর ঘর বাড়ী নেই, ছেলে মেয়ে বর?
ছিল তো, তারা গেছে তেপান্তেরর পর।

জন্মদিনটা ছাড়া শহরের বাকী দিনগুলো একরকম। সারাক্ষণ ঢেউ এর শব্দ আসছে সমুদ্র থেকে। বাতাসে ভাসছে নুন, লোনা হাওয়ায় মন কেমন করে মিমসার। সকালবেলা কেটে যায় স্কুলে বাচ্চাগুলোর সঙ্গে। বিকেল সন্ধ্যেটা একা মতন। খুনখুনে বুড়ীটার কথা মনে পরে, বুড়ীও একলা থাকে; কতদিন ধরে কে জানে! বিকেল বেলা একটা বড় পাথরের উপরে বসে সূর্যাস্ত দেখে মিমসা। জেলেরা বাড়ী ফেরে তখন। সমুদ্রের পাখীগুলো আসে মাছের লোভে। জলের কাছ দিয়ে উড়তে থাকে। বুড়ীকে দেখা যায় না, বুড়ীর বাড়ীটা টানে মিমসাকে।

সন্ধ্যাবেলা একটা ক্যাফেতে গিয়ে বসে থাকে মিমসা। ক্যাফের মালিক হোসে।  টাক মাথা, হাসি মুখ। হোসে এই শহরের নয়। ১০ বছর আগে বেড়াতে এসেছিল, সমুদ্রে ভেসে গেছিল হোসের বউ তিয়া। অনেক খুঁজেও পুলিশ বডিটা পায়নি, তাই হোসে আর যেতে পারেনি শহরটা ছেড়ে। যদি কখনো ফিরে আসে, সেই আশায়। হোসে একা থাকে না, ওর সঙ্গে থাকে গুপুচি, হোসের মিনি বেড়াল। বেড়াল তো নয়, মনে হয় হোসের মেয়ে যেন।    
মিমসা বুড়ীর কথা জিজ্ঞেস করে হোসেকে। 
হোসে বলে রিচার্ড আসবে কদিন বাদে, ওকে জিজ্ঞেস কোরো; ওর নামও বুড়ী দিয়েছিল।  
কফি খেয়ে ঘরে ফেরে মিমসা, কলকাতা মনে পড়ে; ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না তবু। 

পরের দিন স্কুল গিয়ে রোলকল করতে গিয়ে দেখল একজন আসেনি। পরে খোঁজ নিয়ে দেখে তারা চলে গেছে, বাবার ট্রান্সফার। বাচ্চাটা খুব শান্ত আর ইন্ট্রোভার্ট ছিল, তরুর কথা মনে পড়াতো। সামান্য মন খারাপ হয় মিমসার। দুঃখ পেয়োনা, এখানে এরকম প্রায়ই হয়। দ্যাখো তুমি নিজে কদিন থাকতে পারো, সান্ত্বনা দিল কেউ।

ছোট শহরটায় সব আছে- স্কুল, হাসপাতাল, সিনেমা হল আর সব চেয়ে বড় জিনিসটা হল সমুদ্র। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই সিনেমা হল, তাতে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল মিমসা। ঝকঝকে রোদ উঠেছে, হেঁটে হেঁটে সমুদ্রের দিকে গেল। অনেকে চান করছে, খেলছে, বসে আছে। বুড়ীও ছিল সেই দলে। পা ছড়িয়ে বসে আছে, সবাইকে দেখছে, খুশী খুশী মুখ। মিমসা ভাবছিল কথা বলবে কিনা বুড়ীর সঙ্গে। কিন্তু না, বুড়ীর কাজ এসে গেল মনে হয়, চলে গেল নিজের বাড়ীর দিকে। মিমসা দোকান থেকে একটা দূরবীন কিনে ফিরল।

বিকেল বেলা সমুদ্রের ধারে বসে দূরবীন দিয়ে অনেকক্ষণ দেখল, বুড়ীকে দেখা গেলনা। বীচে কোনো পার্টি হবে, সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হচ্ছিল-- খুব হই চই। রাতের বেলা আরেকবার হাঁটতে হাঁটতে বীচে গেল মিমসা।দূর সমুদ্রে জাহাজগুলোর আলো দেখা যায়। ঢেউগুলোর মাথাতেও ফসফরাসের আলো। মিমসাকে চুম্বকের মতন টানছিল সমুদ্রটা। একটু দূরে বীচ পার্টিতে গান হচ্ছে খুব জোরে। মিমসাকে ডাকল ওরা, মিমসারও নাচতে ইচ্ছে করছিল, অনেক রাতে যখন বাড়ী ফিরল বুড়ীর কথা ভুলে গেছে, এই কমাসের মধ্যে প্রথম বার কলকাতা যেতে ইচ্ছে করছে।

আরো কিছুদিন কেটে গেল। স্কুল- বাড়ী- সমুদ্র- দুরবীন- ক্যাফে- সিনেমা।

মিমসা ছবি আঁকতে শুরু করেছে আবার। এখানে সাবজেক্টের ছড়াছড়ি। কিন্তু সমুদ্রবুড়ীর অবসেশনটা যায়নি এখনো। তবে এটা বুঝেছে যে বুড়ীকে আগ বাড়িয়ে বিরক্ত করতে যাওয়া হয়ত ঠিক হবে না। তাই বুড়ীর ছবি এঁকেছে কয়েকটা---চাঁদের বুড়ী সিরিজ।

রিচার্ড এসে গেল একদিন। ক্যাফেতে গিয়ে দেখে হোসের মতনই টাক মাথা, হাসি মুখ। মিমসার কথা অলরেডী শুনেছে, অনেক গল্প করল, নিজের কথা বলল, ছোটো বেলার কথা, এই শহরের কথা, বুড়ীর কথা; বাবার কাছ থেকে শোনা।

" অনেক বছর আগে, তখন এটা শুধুই একটা সমুদ্র সৈকত, শহর নয়; বুড়ী তার বরের সঙ্গে এসে থাকতে শুরু করেছিল। জেলেদের ভালবাসত, বিপদে সাহায্য করত। বুড়ীর ছেলে মেয়ে ছিল না, জেলেদের বাচ্চাদের নিজের ভাবত। স্কুল খুলেছিল বাচ্চাদের জন্য। তারপর যা হয়। ঝড় এল সমুদ্রে। অনেক মারা গেল। তার মধ্যে রিচার্ডের দাদুও ছিল।সেই বিপদের দিনে বুড়ী ম্যাজিকের মত পুরো জেলেবস্তিকে খাইয়েছিল। দিনের পর দিন। সেই থেকে বুড়ীই এদের মা। চেরী গাছটা ওর হাতেই পোঁতা। যবে থেকে চেরী গাছে ফুল ধরছে, জেলেদের কোনো অনিষ্ট হয়নি। হবেও না, যতদিন গাছে ফুল ধরবে ততদিন---রিচার্ডের তাই মনে হয়। 

হোসে হাসে--- ওসব বানানো গল্প, তিয়া ভেসে গেল কি করে তাহলে।
রিচার্ডের মুখটা ছোটো হয়ে যায়। হোসেকে সান্ত্বনা দেয়।

তিয়া ভেসে যেতই--রাতে ক্যাফে থেকে মিমসাকে বাড়ীর দিকে এগিয়ে দেবার সময় রিচার্ড বলে। তিয়া মারা যায়নি, ঝগড়া করে হোসেকে ছেড়ে চলে গেছে। হোসে মানতে পারে না এই সত্যিটা। ওর কাছে তিয়ার সমুদ্রে ভেসে যাওয়াটা সত্যি, অপেক্ষাটা আর বড় সত্যি।

রাতে চিঠি লেখে তরুকে মিমসা, এই কমাসের মধ্যে প্রথমবার। বুড়ীর কথা, হোসের কথা, স্কুলের বাচ্চাগুলোর কথা, চেরী গাছ, সমুদ্র, জেলেরা, সব কিছুর কথা।

শণিবার সমুদ্রে চান করতে যায় মিমসা। হোসে আর রিচার্ডও যায়। মিমসা ছবি আঁকে শুনে রিচার্ড খুব এক্সসাইটেড। ওকে একে দিতে হবে পোর্ট্রেট---মিমসা হাসে, বলে চাঁদের বুড়ীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও আগে তারপর।
সেটা মনে হয় ভাল হবে না। ওকে নিজের মত থাকতে দাও। ও যদি চায় নিজেই এসে আলাপ করে যাবে। ওরা বলে।
মিমসাও মনে মনে তাই ভাবে।

কদিন পরে ক্যাফেতে খুব গন্ডগোল--- গুপুচি দুপুর থেকে বাড়ী ফেরেনি। সারাবিকেল হোসে খুঁজেছে ওকে, কোথাও নেই। সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছে, গুপুচি হয়ত কোনো বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে পালিয়েছে, চলে আসবে। হোসে মানলে তো। সেদিন আর কিছু হলনা, রাস্তা দিয়ে আসার সময় মিমসা কিছুক্ষণ খুঁজল গুপুচিকে; দেখতে পেলনা।
গুপুচি পরের দিনও এল না, তার পরের দিনও না। বাসস্ট্যান্ড, সিনেমা হল সব জায়গায় খুঁজে এসেছে মিমসা আর রিচার্ড গিয়ে। হোসের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা, গুম হয়ে আছে, খাওয়া- ঘুম নেই।

এই কদিন আর সমুদ্রতীরে যাওয়া হয়নি মিমসার। গুপুচিকে খুঁজেছে সময় পেলেই।
আজকে বিকেল গেল। হোসেকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল। আকাশের রং বদলাচ্ছে, পাখিগুলো জলের উপর দিয়ে উড়ছে, মিমসা দুরবীন দিয়ে দেখছিল। বুড়ী বাড়ী থেকে বেরিয়ে ওদের দিকেই আসছে। হাতে একটা সাদা মতন কিছু।

খুনখুনে বুড়ীর কোলে গুপুচি। এল, গুপুচি কে হোসের হাতে দিয়ে ফোকলা মুখে হাসল।
মিমসার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ-তারপর জিজ্ঞেস করল কেমন আছিস মিমাই।
মিমাই --- স্মৃতির অতল থেকে ডেকে উঠল যেন কেউ।
ভালো। হেসে বলল মিমসা।
রিচার্ডও হাসছিল।

এরকমই হয়। বুড়ী যাদের নাম দিয়েছে তারা এই শহরে ফিরে আসেই, ছেড়ে যায় কিন্ত ু  ফিরে আসে একবার অন্তত।

রাতে গুপুচির ছবি আঁকতে শুরু করল মিমসা-- হোসের কোলে গুপচি। কালকে তরুর চিঠিটা পোষ্ট করতে হবে। চাঁদের বুড়ীর সঙ্গে তরুর দেখা করাতে হবে।







  











Thursday, June 9, 2016

দেরী


শুক্রবারের দুপুর। ৩ টেয় বেরতে হবে, ৪ টেয় ট্রেন। খড়্গপুর থেকে কলকাতা। একদম বেরনোর মুখে ঝম ঝম করে বৃষ্টি। আমি আর বি হাঁ করে বসে ছিলাম বৃষ্টি থামার জন্য, তিনি নিজের খুশিতে পড়তে লাগলেন বিকেল ৫ টা পর্যন্ত। আজকে আর বাড়ী যাওয়া হল না----- এই ঘ্যানঘ্যানটা যখন তুঙ্গে, বি বলল সাড়ে ৬ টায় ধৌলীতে চেষ্টা করে দেখি। বাড়ী ফেরাটা তখন এতটাই অ্যাট্রাক্টীভ, লাফিয়ে উঠলাম। ব্যাগ নিয়ে, দরজা আটকে, রিক্সা ধরে স্টেশন।  পৌঁছে জানা গেল ট্রেন লেট, দাঁড়িয়ে রইলাম ওভার ব্রিজের মাথায়--- আড়াই ঘন্টা। সাড়ে ৬ টার ট্রেন ঢুকলো সাড়ে ৮ টায়। আমরা চড়ে বসলাম। সাড়ে ১০ টায় হাওড়া, সেখানে থেকে দুজনে দুদিকে যাবো--- ব্যাগ নিয়ে আবার ছুট---আরো ১ ঘন্টা পরে বাড়ী। দুবাড়ীতে ততক্ষণে হাওমাও শুরু হয়ে গেছে --- কিন্ত ু আমাদের কোনো হেলদোল নেই-- দেরী হয়েছে তো কি, বাড়ীতে তো এসে গেছি।


ই দেরীটায় আমার কোনো হাত ছিল না। তার মানে এই নয় যে আমার সময়জ্ঞান তুখোড়, বরং উলটোটাই সর্বজনগ্রাহ্যভাবে সত্যি। সাহা ইন্সটিটুইট এ জয়েন করতে হবে, সকাল ১১ টায় রিপোরটিং। আমি যথারীতি লেট, বাস ট্রামের দেরী নয়, কারণ দুরত্বটা আমার বাড়ী থেকে ঢিল ছোঁড়া। ন ছোটোবেলার অভ্যাসবশত দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তায় আমার জন্য, ফলত দুজনেই লেট। ইন্সটিটুইট  এ সেই দিনটা বিশেষ দিন। গেট এর সিকউরিটি ও তাই কড়া, নাম মিলিয়ে নতুন স্ট ুডেন্টদের ঢোকাচ্ছে, সেই কাগজ ফেরত চলে গেছে ১১ বাজতেই। আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম, ফোন করা হল, বেশ কিছুক্ষণ পরে কাগজ এল, অ্যাডমিশন পেলাম এস আই এন পি তে।

আমার এই দেরী নিয়ে তেমন লজ্জাবোধ কখনো করিনি।একটা পোস্ট পড়েছিলাম তাতে লেখা ছিল যারা দেরীতে আসে তারা আসলে নাকি খুব অপ্টিমিস্টিক--- এতো সহজে আশাবাদী হতে পেরে বরং আনন্দ হয়েছিল।

ত্রিশ বছর কাটিয়ে এটা রিয়ালাইজ করেছি যে মানুষের জীবনটা আসলে একটা প্যাটার্নে চলে, সেটা আবার প্রত্যেক মানুষের আলাদা আলাদা।
এই প্যাটার্নটা কখন মানুষটা নিজে বানায়, আবার কখন প্যাটার্নটাই মানুষটা কে বানায়-- ডিম মুরগীর সমস্যার মতন।

আমার প্যাটার্ন হচ্ছে দেরী হয়ে যাওয়া--- ইচ্ছেয় অথবা অনিচ্ছেয়।
স্কুল শেষ হতে বাড়ীর কাছে কলেজে ফর্ম না তুলে অনেক দূরে একটা কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। ২ মাস পরে কাছের কলেজে আসতে হল, তখন বায়োকেমিস্ট্রির সব চেয়ে দরকারি চ্যাপ্টার পড়ানো শেষ হয়ে গেছে--- আমার জাস্ট দেরী হয়ে গেল।

এম এস সির সময়; এরপরে পি এইচ ডি তে চেষ্টা করব কিনা এই ডিসিশনটা নিতে পারিনি, তাই কোনো পরীক্ষা মন দিয়ে দিইনি। এক বছর বাড়ীতে বসে পড়ে পরীক্ষা দিলাম---আই আই টি তে গিয়ে ফিরে ও আসলাম--- বাইরে থেকে দেখলে এতেও লেট করে ফেললাম।

২০১৪ তে যখন পেপার পাঠালাম তখন ভেবেছিলাম বছরের শেষের দিকে অ্যাক্সেপ্টেড হয়ে গেলে পরের বছর ফেলোশিপ থাকতে থাকতে থিসিস জমা দেব। ১০ মাসে তিনটে রিভিসনের পরে রিজেক্টেড পেপারটা যখন অন্য জার্নালে পাবলিস হলো তখন ফেলোশিপ শেষ--- কাজ অনেক বাকী।

এই লেট হবার ট্র্যাডিশন রাখতেই মনে হয়, জুন মাস চলে এল। যা যা করার ছিল কিছুই করা গেল না।

আনন্দ সংবাদঃ

পুরোটা পড়লেই বোঝা যাচ্ছে যতই লেটলতিফ হই না কেন--- কেঁদে-কঁকিয়ে, হাঁপাতে-হাঁপাতে শেষমেষ এন্ডপয়েণ্টটা টাচ করেই ফেলেছি। প্রত্যেকবার একই ঘটনা। তাই ওটাও আমার জীবনের অন্য একটা প্যাটার্ন। সেই ভরসায় বসে আছি--- বছরখানেক লেট হচ্ছি হয়ত, কিন্ত ু ডেস্টিনেশনে ঠিক পৌঁছে যাব 

যাই হোক না কেন গুণীজনেরা তো বলেই গেছেন ---" লাইফ টেকস টাইম"।

  

   


Tuesday, June 7, 2016

হোস্টেল - হোস্টেল

২০০৯ সালের জুলাই মাসে তিনটে ব্যাগ নিয়ে চল্লাম আই আই টি- খড়গপুর। পি- এইচ ডি অ্যাডমিশন নিতে। আনন্দ উত্তেজনা চরমে-- যতটা না আই আই টি তে  চান্স পাবার জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশী বাড়ী থেকে দূরে গিয়ে একা থাকার জন্য। তখনও তো জানিনা কি কি ওয়েট করে আছে--তবে সে কথায় পরে আসছি।

দিনটা ছিল মেঘলা। হাওড়া থেকে মেদিনীপুর লোকাল ধরে, তারপর রিক্সা করে দিব্যি পৌছে গেলাম। যে ল্যাবে জয়েন করব তারা ক্যাম্পাসের গেস্ট হাউস বুক করে দিয়েছিল, বাবা মা কে নিয়ে সেখানে উঠলাম। সুন্দর সাজানো সবুজ ক্যাম্পাস, হালকা বৃষ্টিতে মনোরম। ল্যাব দেখলাম--- সবার সঙ্গে আলাপ হল--- পরের দিন অ্যাডমিশন হয়ে গেল।  হোস্টেল দেখলাম, শেয়ার রুমে থাকতে হবে--- এত স্ট ুডেন্ট এসেছে নাকি স্থান সঙ্ক্ুলান হচ্ছে না। রুমমেট এর সঙ্গে আলাপ হল--- ওখানেরই এম টেক, এখন পি- এইচ ডি  করবে।

বাবা-মা টা টা করে কলকাতা ফেরত চলে গেল--- শুরু হল জীবনে প্রথম একা থাকা।

প্রথম একলা সকালে ওয়েলকাম করল পিঁপড়েরা--- আনপ্যাকড ব্যাগের উপরে এক গাদা ডিম পেড়ে রেখে।

তারপর ব্রেকফাস্ট--- সকালে সাড়ে আটটার মধ্যে ডিপার্টমেণ্ট যাওয়া--- কোর্স ওয়ার্ক করা--- দুপুরে  হোস্টেল এসে লাঞ্চ--- আবার ল্যাব--- রাতে ডিনার। কয়েক দিনের মধ্যে বোঝা গেল জীবনে সময় বড় কম। দৌড়োতে হবে। নইলে পিছিয়ে পড়তে হবে।

শুরুর তিন দিন মজায় কাটল। খেয়ে নে, ঘুমুতে যা বলার কেউ নেই--- দিব্যি ইচ্ছে মত রুমে ফিরছি, ঘুরছি, বেড়াচ্ছি, বাঁধন ছাড়া। উইকএন্ড এসে গেল-- প্রথম বাড়ী মিস করলাম সেদিন।

সেই উইকএন্ডে আলাপ হল বি এর সঙ্গে----
"কেমন লাগছে এখানে??"
"ভালই তো। বেশ সবুজ চারদিক" এই ছিল আমার উত্তর। পরের এক বছর এটা ছিল আমাদের  স্ট্যান্ডিং জোক।

কয়েক দিনেই বুঝে গেলাম একা একা থাকাটা কিছু সহজ নয়। রীতিমত ট্রেনিং লাগে। স্কুল কলেজে সব কিছু এত দিন দল বেঁধে করেছি,  একলা যে কিছুই করতে শিখিনি , এখন সেটা  রিয়ালাইজ করলাম। বাকিরা দিব্যি আছে, দরকার মত বাজার যাচ্ছে, খাচ্ছে, ল্যাব করছে---  আর আমি এমনই আতুপুতু যে একলা টেক মার্কেট যাবার কথা ভাবলে হাত পা সেঁদিয়ে যাচ্ছে পেটের মধ্যে। ভয়ে নয়, একা একা হেঁটে যাবার বোরডমে।

আস্তে আস্তে বন্ধ ু হল --- ল্যাবে, হোস্টেলে। একলা থাকাটা কমতে লাগল -- কিন্তু আসলে সেটা গোকুলে বাড়ছিল। পি- এইচ ডি যে একটা লোনলি এক্সপিরিয়েন্স, অহোরাত্র মাথায় চড়ে থাকা একটা ঘ্যান ঘ্যানে ব্যাথা-- সেটা বোঝার ম্যাচুরিটি আসেনি তখনো, কিন্তু অস্বস্তিটা জানান দিচ্ছিল।

 আই আই টি তে সবাই সাইকেল চালায়। আমি চালাতে জানিনা, ল্যাব থেকে কোথাও যাবার থাকলে স এর সাইকেলই ভরসা। ৬ মাস থাকার পর সাইকেল  শিখতে শুরু করলাম,  বহুবার পড়লাম, রাস্তার একদম বাঁ দিক দিয়ে যাওয়া নিরীহ পথচারীকে ধাক্কা মেরে ফেললাম , নিজে গোলচক্করে পড়ে গড়াগড়ি খেলাম--- কিন্ত ু শেষমেশ তৎকালীন বসের " এই বুড়ো বয়সে হবে না " এই  উৎসাহদানকে  দুয়ো দিয়ে সাইকেল চালানো  শিখে গেলাম। কদিন পরে বি ও এক পথের পথিক হল, তার পর প্রি ও --- ছ জোড়া ডানা গজালো আমাদের। সেই ডানায় ভর করে পরের ৬ মাস উড়ে বেড়িয়ে ছিলাম।
   
এক বছরে অনেক কিছু হয়েছিল। সব এখানে লেখার মত নয়।
বেশ কয়েকটা হওয়া এবং না হওয়া প্রেমের সাক্ষী হলাম। 
অনেক ঝগড়া আর মিলের ও সাক্ষী হয়েছিলাম---- কখনো তাতে অংশগ্রহনও করেছিলাম।
প্রতিযোগিতা ছিল আবার বন্ধুত্ত ছিল-- সব রকম মিলিয়ে জমজমাট ছিল হোস্টেল আর ল্যাব। দেখতে ভালোই লাগত। হোস্টেলে মেসে বসে লাঞ্চ ডিনারে সবার সঙ্গে আড্ডা দিতেও খুব ভাল লাগত।  

কিন্তু ভালো লাগত না অনেক কিছুই।
ল্যাবের কাজ ভালো লাগত না, ল্যাবমেটরা ভাল কিন্তু বসের সঙ্গে কিছুতেই বনছিলনা। টাইমের বাবুর মত সকালে উঠে ডিপার্টমেণ্ট যেতে কান্না পেত।

খালি ক্লাস করতে ভাল লাগত। বিকেলে ওল্ড বিল্ডিং এ গিয়ে স্পেশাল চা খেতে ভাল লাগত। শনিবার কলকাতা না ফিরলে বিকেলে হোস্টেলের পাপড়ি চাট খেতে ভাল লাগত। উইকএন্ডে খুব দেরী করে ঘুম থেকে উঠে বি এর ঘরে গিয়ে চা খেতাম, সারা দুপুর তিনজনে মিলে আড্ডা মারতাম। রাতে মেস বন্ধ থাকলে খেতে যেতাম হোস্টেলের বাইরে। সেমেস্টার ব্রেকের সময় নাইট ক্যান্টিন এ যেতাম-- শীতের রাত ১২ টায় গরম চা। ল্যাবের পরে ইচ্ছে মতন ঘুরে বেড়াতাম, ছুটিতে এক সঙ্গে বাড়ী আসার জন্য মুখিয়ে থাকতাম।
রাতের বেলা বিল্লুতে গিয়ে মশলা কোলা খেতাম আর এফ এম শুনতাম। খুব মন খারাপের দিনগুলোতে ২.২ তে হাঁটতে যেতাম।

এই ইররিপ্লেসিবল বন্ধুত্ত ছাড়া আই আই টি থাকার অন্য কারণগুলো আস্তে আস্তে আবছা হয়ে যাচ্ছিল। গুলিয়ে যাচ্ছিল প্রফেশনাল আর পারসনাল লাইফ । দিনগুলো ফেলে ছড়িয়ে নষ্ট করছিলাম---  আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম এখানের জন্য আমি নয়।

তাই এক বছরের মাথায় সবার আপত্তি অগ্রাহ্য করে কলকাতা ফিরে আসার ডিসিশনটা নিয়েই ফেললাম। তিনটে ব্যাগ নিয়ে বাবা- মা দিয়ে এসেছিল আই আই টি তে। পরের বছর সবাইকে টা টা করে সাতটা ব্যাগ নিয়ে একা একা ফিরে এলাম গাড়ী ধরে।

ফিরে এলাম--- কিন্তু জীবনে একা চলার খুব জরুরী শিক্ষাটা হাতে কলমে শিখে ফিরলাম।
আপাত দৃষ্টিতে বোঝা না গেলেও এক বছরের অভিজ্ঞতাটা আমাকে অনেক বড় করে দিল।







Monday, June 6, 2016

রাত

 রাতের সময়টা খুব ভাল লাগে মর্জিনার।
সারাদিন কাজ করে এখন সে একটু গা এলিয়ে বসে।
পাশে আলাদিনের আশ্চর্য্য প্রদীপ।
একটু একটু করে প্রদীপে তেল ঢালে মর্জিনা। পরম যত্নে দেশলাই জ্বালায়,  প্রদীপের শিখা জ্বলে ওঠে--- সেই আলোতে আবদুল্লার ছবি ও প্রজ্জলিত হয়ে ওঠে। অল্প হাওয়ায় দোল খায়, মর্জিনার দিকে চেয়ে হাসে।
প্রদীপের কম্পমান শিখায় আবদুল্লার চোখের পাতা পড়ে--- কি যেন বলে ওঠে। মর্জিনা আরেকটু
 ঝুঁকে বসে, ভাল করে শোনার জন্য। বাইরে টিভির শব্দ, তাতে মুখের কথা হারিয়ে যায়--- বাজতে থাকে গান---  রাতকলি এক খোয়াব মে আয়ি।


"ও মাঈ ভুখ লাগা হ্যাঁয়"।

ভুখ। ভুখ। সারাদিন আছে এই নিয়ে।

আবদুল্লার কাছ থেকে সরে যায় মর্জিনা। রুটি বেলতে হবে, খেতে দিতে হবে। সর্বগ্রাসী খিদে এই বাচ্চা দুটোর পেটে--- মাঝে মাঝে ভাবে মর্জিনা। যেমন ছিল ওদের বাবার--- যতো খিদে তত তেষ্টা। সেই তেষ্টার দাম দিতেই এখন ছবি হয়ে দোলে আবদুল্লা। 

নেশার তেষ্টা। কম পয়সায় দামি নেশার দাম।

আর ভাবতে পারে না মর্জিনা। তার এখন রাতের অনেক বাকি। কালকের মধ্যে ব্লাউসগুলো সব রিফু করে দিতে হবে, নইলে টাকা কাটবে।

রুটি খেয়ে বাচ্চা দুটো ঘুমোয়। পাশাপাশি, জড়াজড়ি করে।

মর্জিনা কাজ নিয়ে বসে। হাজার সুতোর কাজ। কেরোসিনের আলোতে ঝিকমিক করে ওঠে চুমকি- জরি। চল্লিশ চোরের গুহাতে মণি মানিক্যের মাঝে বসে মর্জিনা সেলাই করে।  








বাঘ মানুষের গল্প

(বিশেষ ঘোষনাঃ সব চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে মিল পাঠকের কল্পনাপ্রসূত।)


কণামান্দা সকাল বেলা উঠে হালুম হালুম করে ঘুরে বেড়ায়। এদিক ওদিক দ্যাখে, কে কে উঠল !

কচিমান্দা এখনো উঠল শুয়ে আছে--- সারা রাত জেগে তাঈমান্দার সঙ্গে গল্প করবে--- সকালে উঠবে কি করে!

বাবামান্দা সেই সাত সকালে উঠে গেছে---  রোজকার মতো অ্যালার্ম বাজিয়ে কণামান্দার ভোরবেলার সুখনিদ্রা বরবাদ করেছে। বাবামান্দা কে রোজের মতন বকবে কণামান্দা। বাবামান্দা পাত্তা ও দেবে না, তার এখন অফিস গাড়ি ধরবার তাড়া।

রোজ অফিস যাবার কি দরকার--- আগেই বলেছিলাম জঙ্গলটা শিফট কোরোনা। দিব্যি হেঁটে অফিস যেতে।

উফফ এককথা রোজ বোলোনা বাঘ গিন্নী। খেতে দাও।

কি খাবে-- কালকে তো হরিণ আনোনি। শেয়ালের মাংস খাও।

হ্যাঁ তাই দাও। গাড়ি বেরিয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি দাও।

বাবামান্দা বেড়িয়ে যেতেই কণামান্দার নজর পড়বে কচিমান্দার উপরে।
ওরে ওঠ ওঠ। সবাই ইস্কুলে চলে গেল। শিকার শিখতে চলে গেল। তুই সারা রাত জেগে গল্প করিস, সকালে উঠিস না। তোর কি হবে জীবনে। শুয়ে থাকলে ঠাকুরমান্দা তোকে দেখবে নাকি বিদ্যা বুদ্ধি সাহস দেবে।

চুপ করো তো। ঘুমুতে দাও।

হ্যাঁ। ঘুমিয়ে থাক!

বাধ্য হয়ে কচিমান্দা উঠে ইস্কুলে যায়। এখন কণামান্দা ঘুরে বেড়াবে, জেঠিমান্দার সঙ্গে গল্প করবে, খাবে, ঘুমুবে।

আর শালুক পাতায় মোড়া শামুকের আচার খেতে খেতে বিজনেস প্ল্যান বানাবে, এটা তাদের ফেভারিট পাস টাইম।

রিসেন্ট বিজনেস প্ল্যানঃ পারফুমের ব্যাবসা। নতুন সার্ভেতে দেখা গেছে বাঘেরা আর নিজেদের ঘেমো গন্ধ পছন্দ করছে না। এখন ফিউশন গন্ধের ট্রেন্ড। জুঁই- ভুঁইচাঁপা আর কচি পাঁঠার গন্ধ মিশিয়ে একটা নতুন পারফুমের খোঁজ পাওয়া গেছ; কোনো এক গ্রাম্য বাঘ সেটা বানিয়েছে কিন্ত ু পুঁজি নেই--- এই পেটেন্টটা কিনে নিয়ে ব্যাবসা শুরু করার ইচ্ছে দুজনের।

সন্ধেবেলা বাবামান্দা অফিস থেকে ফিরলে হালুম হালুম করে অফিসের গল্প শুনবে কণামান্দা। বাবামান্দা কাজ করে ব্যাঘ্র ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টে। এখন বাঘরা আর খোলা আকাশের নীচে থাকে না, সরকারী বাঘেদের কোয়াটার্স আছে-- সেই দপ্তরে।

তারপর দুজনে মিলে "বনের খবর" নিউজ চ্যানেল খুলে নিউজ দেখবে। এরপরই শুরু হবে তাদের প্রিয় সিরিয়াল---- "জঙগলে মানুষ, অসহায় বাঘ।" কি ভাবে একটা বাঘ সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাঘদের মনুষ্য আগ্রাসন এবং নতুন সভ্যতার কবল থেকে রক্ষা করল তাই নিয়ে জমজমাটি গল্প।

এরপর আছে আরো সিরিয়াল---" গোয়েন্দা বাঘ এবং পাজি শেয়াল"---নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে
 কি নিয়ে গল্প।

এই সব শেষ হতে না হতেই কচিমান্দা ইস্কুল - টিউশন সেরে বাড়ী ফিরে আসবে। আজকাল আবার নতুন নাটক হয়েছে--- টিউশন নিতে হচ্ছে লেভেল ২ পাস করার জন্য। তবে যা কম্পিটিশনের বাজার, ভালো করে পাস করতে না পারলে চাকরি জুটবে না , তখন বেকার ব্যাঘ্র যোজনায় নাম লেখাতে হবে।
তাই কণামান্দা কোনো রিস্ক না নিয়ে কচিমান্দা কে হালুম বুড়োর টিউশনে দিয়েছে।

হালুম বুড়ো, আসল নাম শ্রী শ্রী  ব্যাঘ্র পন্ডিত জগামান্দা -- তালিম কাবুল আজাদ বিন তুঘলক।

কারিকুলাম ভিটেঃ

 ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হেডমাস্টার ----- ঘেঁয়াও ঘেঁয়াও--- "জঙ্গল মে মঙ্গল, মেরে উড়িয়ে দেব কাঁথা কম্বল" গ্রন্থের রচয়িতা, প্রকাশক, বিক্রেতা। 

বি ঘেঁয়াও, এম ঘেঁয়াও ঘেঁয়াও, এল এল বি হালুম , পি এইচ ডি ঘ্রীঈ ঘ্রীঈ-----  

থেসিস টাইটেলঃ মনুষ্য আগ্রাসনে বিকৃত বাঘ সমাজের ইতিহাস এবং তার পুনর্লিখন

অন্যান্য বইঃ 

 নং ১ঃ "হাও নট টু ফীল প্রেশারাইশড বাই হিউম্যান টেকনোলজী অ্যাডভান্সমেন্ট "---(How not to                  feel pressurized by human technology and advancement)

 নং ২ঃ " হাও টু কীপ ইনোসেন্ট কাবস্ অ্যাওয়ে ফ্রম হিউম্যান কন্সপিরেশি লাইক মোবাইল অ্যান্ড                      আই ফোন"---(How to keep your innocent cubs away from human conspiracy like mobile                    and i - phone)

নং ৩ঃ "কিপ ইয়র কাবস্ অ্যাওয়ে ফ্রম ফ্রোজেন ফুড--- গো ফ্রেশ, বি হেলদী" ---- ( Keep your cubs                  away from frozen food-- go fresh, go healthy)

এই সব বইয়ের বাঘা ভাশর্নের প্রচুর কাটতি বাজারে---- তবে "জঙ্গল মে মঙ্গল, মেরে উড়িয়ে দেব মানুষের কাঁথা কম্বল" এটাই বিখ্যাত করে রেখেছে হালুম বুড়োকে।

কচিমান্দা বাড়ি ফিরলেই কণামান্দার প্রশ্ন শুরু--- ইস্কুলে - টিউশনে কি কি হল---  কি শেখাল ---কে কটা পারল---- জলের ছাপ নিতে কদ্দুর শিখল--- টিউশনে পরীক্ষায় কে কত পেল-- এই সব  উত্তর দিতে দিতে কচিমান্দা রেগে কাঁই, তার "ঘেঁয়ো গলায় বাঘা গানঃ কনটেম্পোরারি মুজিক" এর প্রোগ্রাম শুরু  হয়ে যাচ্ছে। কণামান্দা এই নতুন গানটান একদম পছন্দ করে না--- তার পছন্দ বাঘা ক্ল্যাসিক, প্রয়াত ওস্তাদ ওয়াঁও ওয়াঁও  বিলায়েতি মান্দার গান।
গান নিয়ে ঝগড়া যখন প্রায় শুরু শুরু তখন বাবামান্দা ইন্টারভেন করে ঝগড়া থামাবে।
কণামান্দা রোজকার মতন গজগজ করবে-- " আমি তো ভালোর জন্যি বলি। পড়ার কথা বললেই যত রাগ। না শিখলে হবে কি করে...সবাই এগিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন ঢ্যাং ঢ্যাং করে দমাদ্দম পিটছে-- এগুলো গান নাকি ---- হু হুউউ-- কোনো রুচি বোধ তৈরী হল না এ যুগের বাচ্ছাদের।"

গজগজ করতে করতে ডিনার খাবার সময় এসে যাবে-- তখন আবার " বাঘা নাচে ঢোলক গলায়" এই রিয়ালিটি শো সুরু । অম্নি কণামান্দা সব ভুলে শো দেখতে দেখতে ডিনার খাবে।

খেয়ে উঠে কচিমান্দা একটু হোম ওয়ার্ক করে নিয়ে তাঈমান্দার সঙ্গে গল্প করতে বসবে।
কণামান্দা আর বাবামান্দা ঘুমুতে যাবে।

কালকে আবার আরেকটা ব্যাঘ্রদিনের শুরু।








Friday, June 3, 2016

সংকল্প

বায়োপ্সি রিপোর্টটা হাতে পেয়ে বিশ্বাস হচ্ছিল না তটিনীর। ডাক্তার আসতে এখনো ১ ঘন্টা দেরী। বাবা- মা হাঁ করে চেয়ে আছে-- কি বলল রিপোর্টে ।
আসুক ডাক্তার -- তখন জানবে।
রিপোর্টটা কেড়ে নিয়ে দেখলেন বীণা মল্লিক। ৪০ বছর হাসপাতালে চাকরি করেছেন-- মেডিক্যাল টার্ম বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়।

তটিনী কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না--আসলে চাইছিল না। এরকম হয় নাকি--- আর এক মাসের মধ্যে থিসিস জমা পড়বে-- চার মাস পরে ড্যাং ড্যাং করে দিল্লিবাসী হবার কথা।

লাস্ট ইয়ার ফেব্র ুয়ারী তে আলাপ--- জুলাই তে দুবাড়ীতে কথাবার্তা , পুজোর সময় ডেট ফিক্সড, বাড়ী ভাড়া সব ফাইনাল। এখন আবার এসব হয় নাকি--- বস্তা পচা ইমোশনাল সিনেমার পর্দায় ছাড়া। বায়োপ্সির সময় ডাক্তারের উৎকন্ঠা-ভরা ব্যবহার দ্যাখার পর থেকে এই সিনেমার প্লট নিয়ে বহু আলোচনা হয়ে গেছে দুজনের মধ্যে।

ডাক্তার এলেন।  রিপোর্ট কনফার্ম হল।
গাদা গাদা ফোন- বাড়ীতে, ল্যাবে। নতুন হাসপাতালে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দেওয়া--- আর অনেক কিছু।

তটিনীর ভয় করছিল না। তটিনীর জাস্ট বিশ্বাস হচ্ছিল না।
বাড়ী ভরতি লোক। ফোনের পর ফোন-- বন্ধ ু দের, ল্যাবের। বাকিদের খুব ভয় করছিল। তটিনীর সামনে যদি ও সবাই খুব সাহসী ছিল। তবে বীণা দেবী সাহসী ছিলেন না। এমনিতেই তিনি সদা  উদগ্রীব একমাত্র মেয়েকে নিয়ে--- মেয়ে খেলোনা, ঠিক সময়ে ঘুমোলো না, পেপার ছাপাতে পারল না- সব কিছু নিয়েই তিনি উদগ্রীব। তাই তিনি কেঁদেছেন-- পরের দুমাস ধরে, নিজের কপালকে আর ঠাকুরকে দোষারোপ করেছেন।

এসব চলতে থাকছিল। তাই  নিয়ে আজকের গল্প নয়।
আজকের গল্প তটিনীর রেসোলিউশন নিয়ে-----নিজের কাছে  প্রমিস করা আর ভাঙ্গার গল্প।

তটিনী নতুন হাসপাতালে গেল। অসুখ হয়েছে কিনা এই অ্যান্টিসিপেসশনটা কেটে গেছে। শান্তি হয়েছে --- অদ্ভুত একটা অবিশ্বাস্য শান্তি--- অশান্ত এক ঝড়ের আগের শান্তি।

সেখানে ভাঙল প্রথম রেসোলিউশন--- " আই নো ইয়্যু হ্যভ বীন ভেরী স্ট্রং", ডাক্তারের কথায় কেঁদে ফেলল তটিনী-- পরের মুহূর্তে সামলে নিল যদিও নিজেকে।

পরের সপ্তাহ গেল ঝড়ের মতন। গাদা গাদা টেস্ট। অসুখ কদ্দুর ছড়িয়েছে, কত তাড়াতাড়ি দৌড়াচ্ছে  সব দেখতে হবে।

প্রফেসার বাবু চলে এলেন। রিপোর্ট এল---ভাল রিপোর্ট। লোকালাইজড। সেরে যাবে--- শুধু চুস করতে হবে এক্ষুনী--- কয়েকটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন, যেটা তটিনী মাঝে মাঝে দেখছিল আর সুস্থতার মধ্যে। অপশন ছিল কয়েকটা--- না থাকার মতই। তটিনী ইমিডিয়েটলি কেমোথেরাপীতে ঢুকলো।

ভয় পাবো না--- এই  রেসোলিউশনটা ভেঙ্গে গেল দুই নং কেমোথেরাপীর পর। চেপে রাখা ডিপ্রেশনটা আকার নিতে শুরু করল।

দিনের পর দিন একা বেরোতে না পারার কষ্ট--- ল্যাব না যাবার ডিপ্রেশন। সবাই আছে সারাক্ষণ ঘিরে, একটা আর্জেন্ট ফোনে দৌড়ে আসছে সব কাজ ফেলে, যারা এতো দূরে আছে যে চাইলেও আসতে পারছে না, সর্বক্ষণ ফোন করছে-- খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে-- রোজ আপডেট যাচ্ছে মেইলে -- তাও কোথায় যেন একলা হয়ে যাচ্ছে তটিনী। সেই একলা হবার ভয় গিলে নিচ্ছে তটিনীকে মাঝে মাঝে-- আবার নো ফেস এর মতন বের করে দিচ্ছে সেন এর রিকোয়েস্টে (Ref: Spirited Away    http://www.imdb.com/title/tt0245429/ )।

ভয় কি একটা !! ভোরবেলা ওঠার ভয়, সারাদিন ওয়েট করার ভয়, ব্লাড রিপোর্টের ভয়, অল মোস্ট শুকিয়ে যাওয়া শিরাতে সূচ ফোটানোর ভয়, চ্যানেলে ব্যাক ফ্লো হবার ভয়।

হাসপাতালে অসংখ্য রুগী--- এদের সবার সেরে যাবে তো--- এই প্রশ্নের উত্তরের ভয়। ডে কেয়ারে দেড় বছরের বাচ্চার মায়ের সঙ্গে আলাপ হবার ভয়। আসমানী, বয়স সাত, বাংলাদেশে বাড়ী, তিনটে কেমো নিয়েছে, আরো ১২ টা বাকি---- হীম হয়ে যায় তটিনীর বুক। এত সহজে চোখে জল আসে কি করে মানুষের !!

আর আছে সব চেয়ে বড় একটা ভয় ---যেটা নিয়ে তটিনী কথা বলেনা, সামনে কাউকে বলতে দেয় না। সেই ভয়টাই সব চেয়ে নাছোড়বান্দা--- ঠিক তক্কে তক্কে থাকে-- কেমোর পর যখন ডিফেন্স কম-- হু হু করে মরতে থাকে ব্লাড সেল---ঝিম ঝিমে মাথা---তটিনী যখন থাকে না ঠিক নিজের মধ্যে তখন লাফিয়ে পড়ে ওর উপরে--- চান ঘরের দেওয়ালে ওত পেতে থাকে--- একা তটিনীর জন্য।

তবে একটা রেসোলিউশন  এখনো ভাঙেনি----
দোষারোপ করেনি তটিনী নিজেকে--- আনলাকি ও ভাবেনি নিজেকে।
হোয়াই মি!!! এই প্রশ্নটা তোমাকে দুর্বল করে দেবে---  ওয়েস্টার্ন ব্লটের প্রোটোকল থেকে রেজাল্ট অ্যানালিসিস যিনি হাতে ধরে শিখিয়ে ছিলেন-- তাঁর এই সাবধান বাণীটা ছিল তটিনীর তৃতীয় রেসোলিউশন।
এইটা তটিনী ভাঙেনি এখনো।

অজস্ব্র সাহায্য হাত, অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা--- অসং্খ্য চেনা- অচেনার শুভচিন্তা। তটিনীর পরীক্ষাটা কঠিন, প্রতি মুহূর্তে অপেক্ষা করে আছে সারপ্রাইজ--তাও তটিনী জিতবে। এতো সহজে হারা যায় নাকি।  এত লোকের সাহায্য আর প্রেয়ার মিথ্যা হয় নাকি!!  এই শেষ রেসোলিউশনটা ও তটিনী ভাঙবেনা।