statcounter

Sunday, July 23, 2017

মধুচন্দ্রিমা- পর্ব ১- দিল্লী- মানালী- নগর

মান্ডি হাউসের সামনে থেকে কাঁটায়- কাঁটায় সন্ধ্যে ৭.৩০ টায় হিমাচল ট্যুরিজমের বাস ছাড়ল।সামনে ১৪ ঘণ্টার জার্নি। বাস চলল উত্তরের দিকে, শহরের ভীড় কাটিয়ে হাইওয়ে ধরে। পাশে ধূ ধূ মাঠ--বা ক্ষেত আর মাঝে মাঝে বেমানান ভাবে একটা ধাবা কিংবা ম্যাকডোনাল্ডস, কে এফ সি; তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সারি-সারি দেশী-বিদেশী গাড়ি। মাঝখানে একটা ধাবাতে বাস দাঁড়াল, ডিনার এখানেই হবে। তারপর আর কোন বিরতি নেই, রাতের বাস চলল চন্ডীগড়ের মধ্যে দিয়ে হিমাচলের দিকে। আধো ঘুম, আধো জাগরণের মধ্যে পার হয়ে গেলাম বিলাসপুর আর সুন্দরনগর, পাশে চলতে শুরু করল বিয়াস নদী। সামনের ছয়দিনে এই নদী থাকবে আমাদের যাত্রাপথের সঙ্গী হয়ে, কখনো শান্ত, কখনো খরস্রোতা রূপে। ভোরের আলো ফুটতে দেখা গেল বিয়াসের পাশ দিয়ে ধাপে ধাপে উঠে গেছে  ঘন জঙ্গলে ভরা পাহাড়, তার মধ্যে দূরে একটা দুটো লাল টিনের চালওলা বাড়ি। বাস চলল বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের আঁকা বাঁকা রাস্তা ধরে; পার হয়ে গেলাম নাম না জানা ব্রীজ, ছোট ছোট লোকালয়। সকাল ৯ টায় বাস পৌছাল মানালীতে, সেখান থেকে আমরা যাব আরো ২০ কি মি দূরে; নগরে (নাগ্গর)।
মানালী থেকে নগর যাবার দুটো রাস্তা;  বিয়াসের দুদিক দিয়ে; একটা শহরের পাশ কাটিয়ে আর অন্যটা শহরের মধ্যে দিয়ে কুলুর দিকে। নগর হচ্ছে কুলুর রাজধানী; দিল্লী থেকে নগর যেতে হলে  মানালীতে না গিয়ে নামা উচিত পাতলিকুলে; সেখান থেকে নগর  ৫ কিমি  দূরে। রাস্তার পাশে আপেল বাগান; ভর্তি হয়ে আছে ছোট ছোট সবুজ আপেলে--পাকতে শুরু করবে আগস্টে। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে গাড়ী চলল আর মিনিট ৪৫ এ পৌছে গেলাম নগরে।
নগরে আমাদের থাকার কথা নগর ক্যাসেলে। ১৬০০ শতকে কুলুর রাজা বানিয়েছিলেন এই ক্যাসেলটি, যা এখন একটা হেরিটেজ সাইট এবং হিমাচল ট্যুরিজমের হোটেল। কাঠ আর পাথরের তৈরী বাড়িটা কুলু এবং ইউরোপীয়ান মিশ্র ধাঁচে গড়া। 
প্রথম দিন হোটেলে পৌছে ভীড় দেখে হকচকিয়ে গেছিলাম; হেরিটেজ সাইট টা ৩০ টাকা প্রবেশ মূল্য দিয়ে সর্বসাধারণের জন্য খোলা। গরমের ছুটি এখনো শেষ হয়নি; মানালীতে যেমন ভীড়; তেমনি ক্যাসেল দেখতে আসার লোকের বিরাম নেই।  যাত্রার ক্লান্তি, ঝিমঝিমে বৃষ্টি, ঘর তৈরী নয়; সব মিলিয়ে মেজাজটা আস্তে আস্তে খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। মেজাজ ঠিক হল ক্যাসেল রান্নাঘরে তৈরী অপূর্ব মাশরুম 'অন টোস্ট আর চীজ ওমলেট খেয়ে; তার সঙ্গে কফি। খিদে মিটতেই আমরা ফোটো সেশন শুরু করে দিলাম; নিজেদের আর সামনে পাহাড়ের।
বিকেলের দিকে বাইরের লোকের ভীড় কমে গেল; তখন একটা টুঁ শব্দ নেই চারপাশে। সামনের 
বারান্দার নিচে একটা পাথর বাঁধানো উঠোন; তার সামনে ধাপে ধাপে নেমে গেছে নগরের উপত্যকা; জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে বিয়াস নদী; আরো সামনে উঠে গেছে পাহাড়ের সারি- সবুজ থেকে নীলচে হয়ে গেছে মাথার দিকে, সকালে মেঘে ঢাকা ছিল, এখন পরিস্ফুট হয়েছে। নগর ক্যাসেলের চারদিকে সবুজে ঢাকা পাহাড়, তার মধ্যে লাল- সবুজ ছাদওলা বাড়ী, দূরে গাছের মাথায় আটকে
আছে ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ। সামনের পাঁচদিন আমরা থাকব এখানে--- মেঘ রোদ আর বৃষ্টি লুকোচুরির মধ্যে---- প্রায় স্বর্গের কাছাকাছি।
পাহাড়ে দেরীতে রাত হয়, যখন সন্ধ্যে হল তখন প্রায় আটটা বাজে। সামনে দূরে মিট মিট করে জ্বলছে শহরের আলো, ঠিক যেন জোনাকিরা জ্বালিয়েছে হাজার প্রদীপ।
পরদিন সকালে শুরু হল রোদ আর মেঘের খেলা। সামনের সব চেয়ে বড় পাহাড়ের মাথায় মেঘগুলো ভীড় করে আছে; আর তার ঠিক বা দিকে খাঁজ থেকে উঁকি মারছেন সূর্য। নীচে জমা হয়ে আছে সাদা সাদা মেঘ; বিয়াসের উপরে জমাট বাঁধছে। আরো দুরের পাহাড়ে তখনো নীলচে আভা; তার মাঝখান দিয়ে নেমেছে নাম না জানা নদী। কিছুক্ষ্ণ পরে আরো মেঘ এসে ঢেকে দিতে লাগল সব পাহাড়গুলো কে, ঠিক যেন নাটক শেষে মঞ্চে পরদা পড়ে গেল সামনে।








প্ল্যান ছিল যে কোনো প্ল্যান থাকবে না; ইচ্ছে হলে টুরিস্টের মত ঘুরব; ইচ্ছে না হলে নগরে বসে থাকব।প্রথম ইচ্ছেটার জয় হল; লাঞ্চের সময় গিয়ে পৌছালাম মানালীতে। মানালী শহরটা ছোট, সরু সরু রাস্তা এঁকে বেঁকে গেছে, তার মধ্যে হোটেল আর দোকানের ভীড়।ইন্টারনেটে আগে থেকে দেখে ঠিক করা ছিল কাসা-বেলা-ভিস্তা তে খাব। ওল্ড মানালীতে সুন্দর সাজানো গোছানো দোকান; পাশে আর ওপরে থাকার জায়গা। আমরা খেলাম চিজ কেক,  ব্র ুশেতা আর কাঠের উনুনে বানানো (মেনুতে তাই বলা ছিল) ফোর সিজন পিজ্জা। 



খাবার খেয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। ওল্ড মানালীতে ভীড় অপেক্ষাকৃত কম, বৃষ্টি ভেজা রাস্তা আর মাথার ওপরে পাইন আর ঝাউ গাছেরা মাথা গোঁজাগুঁজি করে দাঁড়িয়ে আছে; একটু দূরে পাহাড়ের গায়ে আরো সবুজ--আরো আরো বেশি ঘন। হেঁটে হেঁটে যখন গেলাম হাড়িম্বা মন্দিরে তখন অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। মন্দিরে চত্বরে লম্বা লাইন পড়েছে পুজো দেবার- সেই দলের আমরা অংশ নই। মন্দির থেকে একটু দূরে ছোট একটা মিউজিয়াম, সেখানে কিছুক্ষন থেকে ফিরে এলাম মল রোডে। মল রোডে যেন মেলা বসে গেছে; গিজগিজ করছে লোকের ভীড়ে। সেখান থেকে গাড়ি করে বিকেল বিকেল ফিরে এলাম  হোটেলে। 

রাত ১২ টায় বত্রিশে পা দিলাম আমি। ক্যাসেলের পাশে রাগিনী ক্যাফের একটা ছোট্ট দোকান--নাম লাভাজা; সেখান থেকে কিনে আনা হয়েছিল জার্মান বেকারীতে তৈরী অসামান্য স্বাদের ক্যারট কেক; একদম ফ্রেশ। সেটা খাওয়া হল রাতের বেলা। পরদিন যাবার কথা জানা ফলস দেখতে (চলবে)।