statcounter

Monday, June 13, 2016

চাঁদের বুড়ী

খুনখুনে বুড়ী থাকে একলা সমুদ্রের ধারে, বাড়ী আর উঠোন। পেছনের পাঁচিল এর ধারেই সমুদ্র। বুড়ীর বয়সের গাছ পাথর নেই। জেলেরা আসে মাছ ধরে, বুড়ীকে দিয়ে যায়। বুড়ী খুশী হয়, হাসে ফোকলা মুখে। শহরে কোনো নতুন বাচ্চা জন্মালে বুড়ীর ডাক পরে বাচ্চার নামকরণ করতে। বহু বছর ধরে চলে আসছে এই নিয়ম। এই শহরে মানুষের জন্মদিন পালন হয়না, গাছের হয়। কিন্ডারগার্টেনের চেরী গাছের জন্মদিনের দিন শহরে হয় উৎসব। শহর সেজে ওঠে সেদিন। সব গাছে লন্ঠন ঝোলানো হয়। গান  হয়, নাচ  হয়, সবাই খাওয়া দাওয়া করে। বুড়ী গোলাপী জামা, সাদা জুতো পরে আসে। সঙ্গে আনে কাপড়--- জড়িয়ে দেয় চেরী গাছের গায়ে---জন্মদিনের অপরিহার্য অঙ্গ।

চাঁদের বুড়ী চরকা কাটে সামনে তুলোর রাশি
জোৎস্না রঙের কাপড় দেখে তার মুখে ফুটছে হাসি। 
বুড়ী তোর ঘর বাড়ী নেই, ছেলে মেয়ে বর?
ছিল তো, তারা গেছে তেপান্তেরর পর।

জন্মদিনটা ছাড়া শহরের বাকী দিনগুলো একরকম। সারাক্ষণ ঢেউ এর শব্দ আসছে সমুদ্র থেকে। বাতাসে ভাসছে নুন, লোনা হাওয়ায় মন কেমন করে মিমসার। সকালবেলা কেটে যায় স্কুলে বাচ্চাগুলোর সঙ্গে। বিকেল সন্ধ্যেটা একা মতন। খুনখুনে বুড়ীটার কথা মনে পরে, বুড়ীও একলা থাকে; কতদিন ধরে কে জানে! বিকেল বেলা একটা বড় পাথরের উপরে বসে সূর্যাস্ত দেখে মিমসা। জেলেরা বাড়ী ফেরে তখন। সমুদ্রের পাখীগুলো আসে মাছের লোভে। জলের কাছ দিয়ে উড়তে থাকে। বুড়ীকে দেখা যায় না, বুড়ীর বাড়ীটা টানে মিমসাকে।

সন্ধ্যাবেলা একটা ক্যাফেতে গিয়ে বসে থাকে মিমসা। ক্যাফের মালিক হোসে।  টাক মাথা, হাসি মুখ। হোসে এই শহরের নয়। ১০ বছর আগে বেড়াতে এসেছিল, সমুদ্রে ভেসে গেছিল হোসের বউ তিয়া। অনেক খুঁজেও পুলিশ বডিটা পায়নি, তাই হোসে আর যেতে পারেনি শহরটা ছেড়ে। যদি কখনো ফিরে আসে, সেই আশায়। হোসে একা থাকে না, ওর সঙ্গে থাকে গুপুচি, হোসের মিনি বেড়াল। বেড়াল তো নয়, মনে হয় হোসের মেয়ে যেন।    
মিমসা বুড়ীর কথা জিজ্ঞেস করে হোসেকে। 
হোসে বলে রিচার্ড আসবে কদিন বাদে, ওকে জিজ্ঞেস কোরো; ওর নামও বুড়ী দিয়েছিল।  
কফি খেয়ে ঘরে ফেরে মিমসা, কলকাতা মনে পড়ে; ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না তবু। 

পরের দিন স্কুল গিয়ে রোলকল করতে গিয়ে দেখল একজন আসেনি। পরে খোঁজ নিয়ে দেখে তারা চলে গেছে, বাবার ট্রান্সফার। বাচ্চাটা খুব শান্ত আর ইন্ট্রোভার্ট ছিল, তরুর কথা মনে পড়াতো। সামান্য মন খারাপ হয় মিমসার। দুঃখ পেয়োনা, এখানে এরকম প্রায়ই হয়। দ্যাখো তুমি নিজে কদিন থাকতে পারো, সান্ত্বনা দিল কেউ।

ছোট শহরটায় সব আছে- স্কুল, হাসপাতাল, সিনেমা হল আর সব চেয়ে বড় জিনিসটা হল সমুদ্র। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই সিনেমা হল, তাতে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল মিমসা। ঝকঝকে রোদ উঠেছে, হেঁটে হেঁটে সমুদ্রের দিকে গেল। অনেকে চান করছে, খেলছে, বসে আছে। বুড়ীও ছিল সেই দলে। পা ছড়িয়ে বসে আছে, সবাইকে দেখছে, খুশী খুশী মুখ। মিমসা ভাবছিল কথা বলবে কিনা বুড়ীর সঙ্গে। কিন্তু না, বুড়ীর কাজ এসে গেল মনে হয়, চলে গেল নিজের বাড়ীর দিকে। মিমসা দোকান থেকে একটা দূরবীন কিনে ফিরল।

বিকেল বেলা সমুদ্রের ধারে বসে দূরবীন দিয়ে অনেকক্ষণ দেখল, বুড়ীকে দেখা গেলনা। বীচে কোনো পার্টি হবে, সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হচ্ছিল-- খুব হই চই। রাতের বেলা আরেকবার হাঁটতে হাঁটতে বীচে গেল মিমসা।দূর সমুদ্রে জাহাজগুলোর আলো দেখা যায়। ঢেউগুলোর মাথাতেও ফসফরাসের আলো। মিমসাকে চুম্বকের মতন টানছিল সমুদ্রটা। একটু দূরে বীচ পার্টিতে গান হচ্ছে খুব জোরে। মিমসাকে ডাকল ওরা, মিমসারও নাচতে ইচ্ছে করছিল, অনেক রাতে যখন বাড়ী ফিরল বুড়ীর কথা ভুলে গেছে, এই কমাসের মধ্যে প্রথম বার কলকাতা যেতে ইচ্ছে করছে।

আরো কিছুদিন কেটে গেল। স্কুল- বাড়ী- সমুদ্র- দুরবীন- ক্যাফে- সিনেমা।

মিমসা ছবি আঁকতে শুরু করেছে আবার। এখানে সাবজেক্টের ছড়াছড়ি। কিন্তু সমুদ্রবুড়ীর অবসেশনটা যায়নি এখনো। তবে এটা বুঝেছে যে বুড়ীকে আগ বাড়িয়ে বিরক্ত করতে যাওয়া হয়ত ঠিক হবে না। তাই বুড়ীর ছবি এঁকেছে কয়েকটা---চাঁদের বুড়ী সিরিজ।

রিচার্ড এসে গেল একদিন। ক্যাফেতে গিয়ে দেখে হোসের মতনই টাক মাথা, হাসি মুখ। মিমসার কথা অলরেডী শুনেছে, অনেক গল্প করল, নিজের কথা বলল, ছোটো বেলার কথা, এই শহরের কথা, বুড়ীর কথা; বাবার কাছ থেকে শোনা।

" অনেক বছর আগে, তখন এটা শুধুই একটা সমুদ্র সৈকত, শহর নয়; বুড়ী তার বরের সঙ্গে এসে থাকতে শুরু করেছিল। জেলেদের ভালবাসত, বিপদে সাহায্য করত। বুড়ীর ছেলে মেয়ে ছিল না, জেলেদের বাচ্চাদের নিজের ভাবত। স্কুল খুলেছিল বাচ্চাদের জন্য। তারপর যা হয়। ঝড় এল সমুদ্রে। অনেক মারা গেল। তার মধ্যে রিচার্ডের দাদুও ছিল।সেই বিপদের দিনে বুড়ী ম্যাজিকের মত পুরো জেলেবস্তিকে খাইয়েছিল। দিনের পর দিন। সেই থেকে বুড়ীই এদের মা। চেরী গাছটা ওর হাতেই পোঁতা। যবে থেকে চেরী গাছে ফুল ধরছে, জেলেদের কোনো অনিষ্ট হয়নি। হবেও না, যতদিন গাছে ফুল ধরবে ততদিন---রিচার্ডের তাই মনে হয়। 

হোসে হাসে--- ওসব বানানো গল্প, তিয়া ভেসে গেল কি করে তাহলে।
রিচার্ডের মুখটা ছোটো হয়ে যায়। হোসেকে সান্ত্বনা দেয়।

তিয়া ভেসে যেতই--রাতে ক্যাফে থেকে মিমসাকে বাড়ীর দিকে এগিয়ে দেবার সময় রিচার্ড বলে। তিয়া মারা যায়নি, ঝগড়া করে হোসেকে ছেড়ে চলে গেছে। হোসে মানতে পারে না এই সত্যিটা। ওর কাছে তিয়ার সমুদ্রে ভেসে যাওয়াটা সত্যি, অপেক্ষাটা আর বড় সত্যি।

রাতে চিঠি লেখে তরুকে মিমসা, এই কমাসের মধ্যে প্রথমবার। বুড়ীর কথা, হোসের কথা, স্কুলের বাচ্চাগুলোর কথা, চেরী গাছ, সমুদ্র, জেলেরা, সব কিছুর কথা।

শণিবার সমুদ্রে চান করতে যায় মিমসা। হোসে আর রিচার্ডও যায়। মিমসা ছবি আঁকে শুনে রিচার্ড খুব এক্সসাইটেড। ওকে একে দিতে হবে পোর্ট্রেট---মিমসা হাসে, বলে চাঁদের বুড়ীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও আগে তারপর।
সেটা মনে হয় ভাল হবে না। ওকে নিজের মত থাকতে দাও। ও যদি চায় নিজেই এসে আলাপ করে যাবে। ওরা বলে।
মিমসাও মনে মনে তাই ভাবে।

কদিন পরে ক্যাফেতে খুব গন্ডগোল--- গুপুচি দুপুর থেকে বাড়ী ফেরেনি। সারাবিকেল হোসে খুঁজেছে ওকে, কোথাও নেই। সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছে, গুপুচি হয়ত কোনো বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে পালিয়েছে, চলে আসবে। হোসে মানলে তো। সেদিন আর কিছু হলনা, রাস্তা দিয়ে আসার সময় মিমসা কিছুক্ষণ খুঁজল গুপুচিকে; দেখতে পেলনা।
গুপুচি পরের দিনও এল না, তার পরের দিনও না। বাসস্ট্যান্ড, সিনেমা হল সব জায়গায় খুঁজে এসেছে মিমসা আর রিচার্ড গিয়ে। হোসের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা, গুম হয়ে আছে, খাওয়া- ঘুম নেই।

এই কদিন আর সমুদ্রতীরে যাওয়া হয়নি মিমসার। গুপুচিকে খুঁজেছে সময় পেলেই।
আজকে বিকেল গেল। হোসেকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল। আকাশের রং বদলাচ্ছে, পাখিগুলো জলের উপর দিয়ে উড়ছে, মিমসা দুরবীন দিয়ে দেখছিল। বুড়ী বাড়ী থেকে বেরিয়ে ওদের দিকেই আসছে। হাতে একটা সাদা মতন কিছু।

খুনখুনে বুড়ীর কোলে গুপুচি। এল, গুপুচি কে হোসের হাতে দিয়ে ফোকলা মুখে হাসল।
মিমসার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ-তারপর জিজ্ঞেস করল কেমন আছিস মিমাই।
মিমাই --- স্মৃতির অতল থেকে ডেকে উঠল যেন কেউ।
ভালো। হেসে বলল মিমসা।
রিচার্ডও হাসছিল।

এরকমই হয়। বুড়ী যাদের নাম দিয়েছে তারা এই শহরে ফিরে আসেই, ছেড়ে যায় কিন্ত ু  ফিরে আসে একবার অন্তত।

রাতে গুপুচির ছবি আঁকতে শুরু করল মিমসা-- হোসের কোলে গুপচি। কালকে তরুর চিঠিটা পোষ্ট করতে হবে। চাঁদের বুড়ীর সঙ্গে তরুর দেখা করাতে হবে।







  











No comments:

Post a Comment