২০০৯ সালের জুলাই মাসে তিনটে ব্যাগ নিয়ে চল্লাম আই আই টি- খড়গপুর। পি- এইচ ডি অ্যাডমিশন নিতে। আনন্দ উত্তেজনা চরমে-- যতটা না আই আই টি তে চান্স পাবার জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশী বাড়ী থেকে দূরে গিয়ে একা থাকার জন্য। তখনও তো জানিনা কি কি ওয়েট করে আছে--তবে সে কথায় পরে আসছি।
দিনটা ছিল মেঘলা। হাওড়া থেকে মেদিনীপুর লোকাল ধরে, তারপর রিক্সা করে দিব্যি পৌছে গেলাম। যে ল্যাবে জয়েন করব তারা ক্যাম্পাসের গেস্ট হাউস বুক করে দিয়েছিল, বাবা মা কে নিয়ে সেখানে উঠলাম। সুন্দর সাজানো সবুজ ক্যাম্পাস, হালকা বৃষ্টিতে মনোরম। ল্যাব দেখলাম--- সবার সঙ্গে আলাপ হল--- পরের দিন অ্যাডমিশন হয়ে গেল। হোস্টেল দেখলাম, শেয়ার রুমে থাকতে হবে--- এত স্ট ুডেন্ট এসেছে নাকি স্থান সঙ্ক্ুলান হচ্ছে না। রুমমেট এর সঙ্গে আলাপ হল--- ওখানেরই এম টেক, এখন পি- এইচ ডি করবে।
বাবা-মা টা টা করে কলকাতা ফেরত চলে গেল--- শুরু হল জীবনে প্রথম একা থাকা।
প্রথম একলা সকালে ওয়েলকাম করল পিঁপড়েরা--- আনপ্যাকড ব্যাগের উপরে এক গাদা ডিম পেড়ে রেখে।
তারপর ব্রেকফাস্ট--- সকালে সাড়ে আটটার মধ্যে ডিপার্টমেণ্ট যাওয়া--- কোর্স ওয়ার্ক করা--- দুপুরে হোস্টেল এসে লাঞ্চ--- আবার ল্যাব--- রাতে ডিনার। কয়েক দিনের মধ্যে বোঝা গেল জীবনে সময় বড় কম। দৌড়োতে হবে। নইলে পিছিয়ে পড়তে হবে।
শুরুর তিন দিন মজায় কাটল। খেয়ে নে, ঘুমুতে যা বলার কেউ নেই--- দিব্যি ইচ্ছে মত রুমে ফিরছি, ঘুরছি, বেড়াচ্ছি, বাঁধন ছাড়া। উইকএন্ড এসে গেল-- প্রথম বাড়ী মিস করলাম সেদিন।
সেই উইকএন্ডে আলাপ হল বি এর সঙ্গে----
"কেমন লাগছে এখানে??"
"ভালই তো। বেশ সবুজ চারদিক" এই ছিল আমার উত্তর। পরের এক বছর এটা ছিল আমাদের স্ট্যান্ডিং জোক।
কয়েক দিনেই বুঝে গেলাম একা একা থাকাটা কিছু সহজ নয়। রীতিমত ট্রেনিং লাগে। স্কুল কলেজে সব কিছু এত দিন দল বেঁধে করেছি, একলা যে কিছুই করতে শিখিনি , এখন সেটা রিয়ালাইজ করলাম। বাকিরা দিব্যি আছে, দরকার মত বাজার যাচ্ছে, খাচ্ছে, ল্যাব করছে--- আর আমি এমনই আতুপুতু যে একলা টেক মার্কেট যাবার কথা ভাবলে হাত পা সেঁদিয়ে যাচ্ছে পেটের মধ্যে। ভয়ে নয়, একা একা হেঁটে যাবার বোরডমে।
আস্তে আস্তে বন্ধ ু হল --- ল্যাবে, হোস্টেলে। একলা থাকাটা কমতে লাগল -- কিন্তু আসলে সেটা গোকুলে বাড়ছিল। পি- এইচ ডি যে একটা লোনলি এক্সপিরিয়েন্স, অহোরাত্র মাথায় চড়ে থাকা একটা ঘ্যান ঘ্যানে ব্যাথা-- সেটা বোঝার ম্যাচুরিটি আসেনি তখনো, কিন্তু অস্বস্তিটা জানান দিচ্ছিল।
আই আই টি তে সবাই সাইকেল চালায়। আমি চালাতে জানিনা, ল্যাব থেকে কোথাও যাবার থাকলে স এর সাইকেলই ভরসা। ৬ মাস থাকার পর সাইকেল শিখতে শুরু করলাম, বহুবার পড়লাম, রাস্তার একদম বাঁ দিক দিয়ে যাওয়া নিরীহ পথচারীকে ধাক্কা মেরে ফেললাম , নিজে গোলচক্করে পড়ে গড়াগড়ি খেলাম--- কিন্ত ু শেষমেশ তৎকালীন বসের " এই বুড়ো বয়সে হবে না " এই উৎসাহদানকে দুয়ো দিয়ে সাইকেল চালানো শিখে গেলাম। কদিন পরে বি ও এক পথের পথিক হল, তার পর প্রি ও --- ছ জোড়া ডানা গজালো আমাদের। সেই ডানায় ভর করে পরের ৬ মাস উড়ে বেড়িয়ে ছিলাম।
এক বছরে অনেক কিছু হয়েছিল। সব এখানে লেখার মত নয়।
বেশ কয়েকটা হওয়া এবং না হওয়া প্রেমের সাক্ষী হলাম।
অনেক ঝগড়া আর মিলের ও সাক্ষী হয়েছিলাম---- কখনো তাতে অংশগ্রহনও করেছিলাম।
প্রতিযোগিতা ছিল আবার বন্ধুত্ত ছিল-- সব রকম মিলিয়ে জমজমাট ছিল হোস্টেল আর ল্যাব। দেখতে ভালোই লাগত। হোস্টেলে মেসে বসে লাঞ্চ ডিনারে সবার সঙ্গে আড্ডা দিতেও খুব ভাল লাগত।
কিন্তু ভালো লাগত না অনেক কিছুই।
ল্যাবের কাজ ভালো লাগত না, ল্যাবমেটরা ভাল কিন্তু বসের সঙ্গে কিছুতেই বনছিলনা। টাইমের বাবুর মত সকালে উঠে ডিপার্টমেণ্ট যেতে কান্না পেত।
খালি ক্লাস করতে ভাল লাগত। বিকেলে ওল্ড বিল্ডিং এ গিয়ে স্পেশাল চা খেতে ভাল লাগত। শনিবার কলকাতা না ফিরলে বিকেলে হোস্টেলের পাপড়ি চাট খেতে ভাল লাগত। উইকএন্ডে খুব দেরী করে ঘুম থেকে উঠে বি এর ঘরে গিয়ে চা খেতাম, সারা দুপুর তিনজনে মিলে আড্ডা মারতাম। রাতে মেস বন্ধ থাকলে খেতে যেতাম হোস্টেলের বাইরে। সেমেস্টার ব্রেকের সময় নাইট ক্যান্টিন এ যেতাম-- শীতের রাত ১২ টায় গরম চা। ল্যাবের পরে ইচ্ছে মতন ঘুরে বেড়াতাম, ছুটিতে এক সঙ্গে বাড়ী আসার জন্য মুখিয়ে থাকতাম।
রাতের বেলা বিল্লুতে গিয়ে মশলা কোলা খেতাম আর এফ এম শুনতাম। খুব মন খারাপের দিনগুলোতে ২.২ তে হাঁটতে যেতাম।
এই ইররিপ্লেসিবল বন্ধুত্ত ছাড়া আই আই টি থাকার অন্য কারণগুলো আস্তে আস্তে আবছা হয়ে যাচ্ছিল। গুলিয়ে যাচ্ছিল প্রফেশনাল আর পারসনাল লাইফ । দিনগুলো ফেলে ছড়িয়ে নষ্ট করছিলাম--- আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম এখানের জন্য আমি নয়।
তাই এক বছরের মাথায় সবার আপত্তি অগ্রাহ্য করে কলকাতা ফিরে আসার ডিসিশনটা নিয়েই ফেললাম। তিনটে ব্যাগ নিয়ে বাবা- মা দিয়ে এসেছিল আই আই টি তে। পরের বছর সবাইকে টা টা করে সাতটা ব্যাগ নিয়ে একা একা ফিরে এলাম গাড়ী ধরে।
ফিরে এলাম--- কিন্তু জীবনে একা চলার খুব জরুরী শিক্ষাটা হাতে কলমে শিখে ফিরলাম।
আপাত দৃষ্টিতে বোঝা না গেলেও এক বছরের অভিজ্ঞতাটা আমাকে অনেক বড় করে দিল।