statcounter

Friday, May 27, 2016

মিসেস সিম্পসন

জায়গাটার নাম বলা যাবে না। এটুকু বলছি কলকাতা থেকে বেশি দূরে নয়, ট্রেনে চড়ে মাত্র ঘণ্টা খানেক, আর জায়গার নামটা উ দিয়ে শুরু।

পুরনো পাড়া, গায়ে গায়ে বাড়ি, লোকজন মিশুকে। আর মিসেস সিম্পসনকে সবাই ভালবাসে।ভালবাসবেই না কেন, সারাজীবন বড়দিনে ভালো ভালো কেক বানিয়ে পাড়ার বাচ্চাদের খাইয়েছেন যে। ছেলে মেয়ে নেই, বছর আটেক আগে মিস্টার সিম্পসন ও মারা গেছেন। তিন তলার ছোট্ট ফ্ল্যাটে  মিসেস সিম্পসন একাই থাকেন। তিন কূ্লে আর কেউ আছে বলে পাড়ার কেউ দেখেনি তবে সিম্পসন বলে গোয়ায় নাকি তাঁর বোন-ভাই সবাই আছে।

তবে একা থাকতে কিছু এসে যায় না সিম্পসনের। তিনি থাকেন নিজের মনের খুশীতে। রোজ সকাল সকাল উঠে মর্নিং ওয়াক করেন। বিকেলে সেজে গুজে, গোলাপী ছাতা দুলিয়ে বাজার গিয়ে মাছ- সবজি কিনে আনেন। প্রতি রোববার গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে যান, গিয়ে বুড়ীর চুল (Candy floss) কিনে খান। আর রাতের বেলা কম্পুটার খুলে কোল্ডপ্লের (Coldplay) গান শোনেন। হ্যাঁ কোল্ডপ্লে---- উইল চ্যাম্পিয়ান, মানে যে লোকটা ড্রাম বাজায় তাকে মনে মনে খুব পছন্দ তাঁর।

মিসেস সিম্পসনের দুটো হবি, 
১) বাইনোকুলার দিয়ে লোকের বাড়িতে কি হচ্ছে দেখা।
২) টিকটিকি পোষা এবং তাদের দিয়ে গোয়েন্দাগিরি করানো।  সিম্পসন কথা বলতে পারেন ওদের সঙ্গে, বুঝতেও পারেন ওদের কথা।
দুটো পোষা টিকটিকি আছে তাঁর --- সাদা এবং কালো। যেমন নাম তেমনি রঙ। তারা খুব কাজেরও।   লোকের বাড়িতে গিয়ে দেওয়ালে স্থির হয়ে বসে থেকে দেখে সবাই কি করছে , কি বলছে , আর সিম্পসনকে রিপোর্ট করে। 
তবে মিসেস সিম্পসন এর এই সুপার পাওয়ারের কথা অবশ্যই পাড়ার কেউ জানে না, জানতো শুধু সিম্পসনের মা আর বর, তারা এখন বহুদিন মরে হেজে গেছে।

মিস্টার সিম্পসন বেঁচে থাকাকালীন বেশী গোয়েন্দাগিরি করা যেত না, তখন ব্যস্ততাও ছিল, বুড়ো রাগ ও করত। এখন বুড়ী বয়সে একা একা থেকে বোরড লাগে মিসেস সিম্পসনের, তাই পুরোদমে চালাচ্ছেন টিকটিকি বিজনেস।

৩ নং বাড়িতে মোটা মহিলা আজকে লাউ চিংড়ী রেঁধেছে। তা খেয়ে তার বর খুব খুশি। কিন্ত ু শুধু সিম্পসন জানে রাঁধার পর পুরোটা মাটিতে পড়ে গেছল, মুটকি সেটাকেই তুলে বর কে খাওয়াচ্ছে। এই খবর এনেছে সাদা। দুধ ভাত খেতে খেতে খুব হাসছে  মিসেস সিম্পসন।

কালোর খবর আরো জব্বর। ৮ নং এ শুঁটকো স্কুল মাষ্টারের শাশুড়ি এসেছে গতকাল। বাইনোকুলার দিয়ে সেটা দেখেই কালোকে ওবাড়িতে পাঠিয়েছিলেন। মা আসাতে শুঁটকোর বউ খুব খুশি, রান্না সব মা ই করছে। চাটগাঁয়ের রান্না, শুঁটকী মাছ, কচুর শাক আর হেন তেন কত কিছু। শুঁটকী মাছের গন্ধে পাড়া সুদ্দু ম ম করছিল সকালে। মাষ্টার বাড়ি ফিরে এসে রান্না দেখে প্রায় অজ্ঞান, এসব খায় না সে। কচু খেলে তার গলা চুলকোয় নাকি। এই নিয়ে ধুন্ধমার লেগেছে ৮ নং এ। আরেকটু হলে বউ বাপের বাড়ি যাচ্ছিল। এখন রাতে মাষ্টার শিবুর দোকানের রুটি আলু খাচ্ছে, ফ্রিজে পায়েস আছে রাখা কিন্ত ু বউ শুঁটকো কে সেটা দিচ্ছে না।

এইসব করে ভালই দিন কাটছিল মিসেস সিম্পসনের। আগেই বলেছি পাড়াটা ভাল, সামান্য হিংসা- হিংসি আছে, তবে যেটুকু  না থাকলে পাঁচটা মানুষ এক জায়গায় আছে বোঝা যেত না। ৯ নং নতুন পরদা লাগালে, ১৬ নং ও লাগাল। ২১ নং নতুন গাড়ি কিনতে সবাই মুখ বেঁকিয়ে বলল ঘুষের পয়সায়, তবে গাড়ি কেনার মিষ্টি খেতে কেউ আপত্তি করেনি।

তবে জীবনে কোনো সুখই চিরস্থায়ী নয়----গুণিজনরা বলে গেছেন, লীলা দিদা ও তাই বলতেন। তাঁর কথা সত্যি করার জন্যই এক আপদ উপস্থিত হল পাড়ায়--- নোটিশ এল পাড়া খালি করার।
এই পাশাপাশি যে পাঁচটা বাড়ি তাদের নাকি কোন কাগজপত্র নেই, তাই বাড়ি ফাঁকা করে দিতে হবে। এই পুরনো বাড়ি ভেঙ্গে নাকি নতুন মল উঠবে। কাগজপত্র ছিল কিনা সত্যি কেউ জানে না, সবার তিন পুরুষ ধরে বাস, বাড়ির ভাড়া তুলে কলকাতার ঠিকানায় পাঠানো হত আগে, লাষ্ট পঁচিশ বছর আগে সেই ঠিকানায় কেউ থাকে না। সবাই সুখে শান্তিতে ছিল এতদিন। এখন কর্পোরেশন নামক আপদ এসে হাজির। পাড়ায় হৈ চৈ পড়ে গেল, সবাই গিয়ে অফিসে পিটিশন দিয়ে এল। কিন্ত ু কোনো কাজ হল না, চার মাস সময় পাওয়া গেল, তার মধ্যে চলে যেতে হবে। সবার মন খারাপ, কান্নাকাটি, এমন কি আজকাল  মিসেস সিম্পসনকে গোলাপী ছাতা নিয়ে দেখা যায় না।

এরকম ভাবে এক মাস কেটে গেল। তারপর একদিন খুব উত্তেজনা। শিবুর দোকানে নাকি একটা হোঁৎকা মতন লোক আর তিনটে গুন্ডা  টাইপ এসে চা খেতে খেতে গল্প করছে, শিবু দোকানে ছিল না, শিবুর ছেলে শুনেছে। এই পাড়া খালি করানোর জন্য অনেক ঘুষ খেয়েছে কর্পোরেশন ওলারা। এখনো পাড়া ফাঁকা হয়নি বলে হোঁৎকার বস, তার নাম হেডুদা সে রাগারাগি করছে।

মিটিং বসে গেল, কিন্ত ু উপায় কিছু বেরল না। শুধু বুড়ো তালুকদার বলল কাগজ একটা আছে বলে মনে হচ্ছে মাঝে মাঝে,  মনে হচ্ছে  তার বাবার মুখে শুনে ছিল। সবাই তেড়িয়া হয়ে বলল এত দিন কেন বলেনি---- কাগজ কোথায়----দেখা গেল বুড়ো্র আর কিছু মনে নেই। মিটিং ভেঙ্গে গেল। বুড়োর মাথার দোষ ছিল, তার সঙ্গে ভুলে যাবার অসুখ, তাই কেউ বিশ্বাস করত না তাকে।

খালি মিসেস সিম্পসন অবিশ্বাস করল না। এই শিক্ষাটা তাঁর মার থেকে পাওয়া। 

ফ্ল্যাটে ফিরে মিসেস সিম্পসন ভাবতে বসলেন। কাগজ খুঁজতে হবে, পাঁচটা বাড়ি, চল্লিশটা ফ্ল্যাট। মুখের কথা নয়। কেমন কাগজ তাও জানেন না, টিকটিকিদের ভাল করে না বললে ওরা পারবে কেন। চিন্তায় পড়ে গেলেন মিসেস সিম্পসন। এদিকে সময় ও বেশী নেই। ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে গেল। একটু ঠান্ডা হাওয়া লাগানো দরকার। দু হপ্তা  গঙ্গার ধারে যাননি, আজকে গেলেন। বাক্সে পুরে
টিকটিকিদের ও নিয়ে গেলেন। পাড়ে বসে থেকে দু খানা বুড়ীর চুল খেলেন। স্টীমারের ভোঁ শুনলেন, সূর্য্য ডুবে যাওয়া দেখলেন। টিকটিকিদের জন্য নকুলদানা কিনে যখন বাড়ি এলেন, মাথা পুরো ঠান্ডা, বুদ্ধি খুলেছে।

পরের দিন মিসেস সিম্পসন গেলেন কর্পোরেশন অফিসে। হাতে ব্যাগ, তাতে সাদা আর কালো। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সাদা- কালো কে রেখে চলে এলেন। আবার পরদিন গেলেন--- কোনো খবর আছে কিনা জানতে। দু তিন দিনে সাদা- কালো বাকি টিকটিকিদের সঙ্গে বন্ধুত্ত করে ফেলেছে, নকুল দানা খেতে সবাই ভালবাসে কিনা। রোজ রোজ মিসেস সিম্পসন গিয়ে নকুলদানা জোগাড় দিতেন। টিকটিকিরা সারাদিন অফিসের দেওয়ালে বসে লোকে্দের উপরে নজর রাখত, রাতে মিটিং এ সাদা- কালো কে সব জানাত। ১ সপ্তাহ কাটল। তারপর সাদা- কালো খবর আনল---- হেডুদা আর কেও নয়, বুড়ো তালুকদারের ভাইপো। সে  এখন  বিরাট প্রোমোটার,  কাগজের কথা জানতো আর এটাও জানতো যে অন্য কেউ জানে না এ ব্যাপারে। বুড়ো তালুকদার ভাইপোকে বাড়িতে ঢুকতে দেয় না, সেই জন্য রাগ আছে, লোভ তো আছে ষোলআনা। হেডু যার কিনা আসল নাম অমরেন্দ্রনাথ তালুকদার সে রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে এটা ও বলেছে, বাড়ির কাগজ এর গায়ে কল্কা কাটা, এর লাষ্ট পেজ এ হেডুর নিজের হাতে বক আঁকা। সেই কাগজ টা পেলে এক্ষুনি পুড়িয়ে ফেলে আর যত বুড়ো- বুড়ির দল যারা আজন্ম ওখানে আছে তাদের পাড়া ছাড়া করে। নিজের কাকা হয়ে এমন শত্রতা -- এই শুনে অফিসের সবাই আহা রে আহা রে করেছে। হেডু ওদের বিরিয়ানি খাওয়া কিনা।

যাই হোক মিসেস সিম্পসনের সমস্যা মিটে গেল। সাদা- কালো বাড়ি এসে রাতের বেলা তালুকদারের বাড়ি গেল। কাগজ খুঁজতে অবশ্য আরো দিন তিনেক লাগল।

মিসেস সিম্পসন মিটিং ডাকলেন। বাড়ির কাগজ দেখানো হল। কাগজে পরিস্কার লেখা ছিল বাড়ির ওয়ারিশ মারা যাবার পনেরো বছর পর থেকে এই ফ্ল্যাটের অধিবাসীরাই মালিক হবে, তবে বিক্রি করতে পারবে না। পাড়ায়  মিসেস সিম্পসন আর বুড়ো তালুকদারের নামে ধন্য ধন্য পড়ে গেল।
৯, ১৬ আর ২১ নং মিলে সবাইকে শিবুর দোকানের চা আর জিলিপি খাওয়াল। কর্পোরেশন অফিসে গিয়ে কাগজ দেখিয়ে নোটিশ ক্যানসেল করানো হল। হেডু এসে ছিল, খুব ঘামছিল, পরে নাকি প্রেসার বেড়ে গিয়ে ডাক্তার খানায় গেছে। এই খবর ও শিবুর ছেলে দিয়েছে।

এখন মিসেস সিম্পসনের জীবন আবার আগের মতন হয়ে গেছে। সকালে মর্নিং ওয়াক, বিকেলে বাজার, রোববার গঙ্গার ঘাটে বুড়ীর চুল খাওয়া। খালি এখন মাঝে মাঝে ৮ আর ৩০ নং থেকে  
সিম্পসনকে কেক বানিয়ে পাঠায়, চা খেতে ডাকে। আর মিসেস সিম্পসন আজকাল কোল্ডপ্লের (Coldplay) সঙ্গে কোডালিন (Kodaline) এর গান শোনেন।














No comments:

Post a Comment